‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নত জীবন নিশ্চিত করা। নিজেদের প্রয়োজনেই আমরা কঠোর পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হয়েছি। আমাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে’। এনজিও সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এসডিএফ) ‘নবজীবন’ প্রকল্পের সুবিধাভোগী মনি রানী শীল তাদের দারিদ্র্য জয় করার সংগ্রামের বর্ণনা এভাবেই তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ড. জিম ইয়ং কিং-এর উপস্থিতিতে। মনি রানী শীল বলেন, ২০১২ সালে দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে দরিদ্র ও হতদরিদ্র ১৯৮ নারী ও বেকার যুবকদের নিয়ে গঠন করা হয় গ্রাম সমিতি। এ সমিতির মাধ্যমে গ্রামের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করে বাজেট প্রণয়ন শেষে সদস্যদের মধ্যে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গাভী পালন, সবজি চাষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক খাতে ৪৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করে এনজিওটি। এসডিএফ’র নবজীবন প্রকল্পের ঋণ পেয়ে বিভিন্ন আয়বর্ধক খাতে বিনিয়োগ করে দরিদ্র নারী ও বেকার যুবকরা এখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেছে।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে এসডিএফ পরিচালিত দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রাম সমিতির সুবিধাভোগী দরিদ্র নারীদের স্বচ্ছলতা ফিরে পাবার বর্ণনা শুনে অভিভূত হয়ে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ড. জিম ইয়ং কিম বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী-পুরুষরা খুবই পরিশ্রমী ও কর্মঠ। তারা পিছিয়ে থাকতে জানে না। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, রাকুদিয়া গ্রাম সমিতির নারীদের ভাগ্য উন্নয়নের কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করেছে। এ প্রকল্প শুরুর আগে এসব নারীরা কোন প্রশিক্ষণ পায়নি। ড. জিম ইয়ং কিম আরও বলেন, এসডিএফর নবজীবন প্রকল্পের সহায়তা নিয়ে দরিদ্র নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছে দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করার পর রাকুদিয়া গ্রামের দরিদ্র নারীরা প্রশিক্ষণ পেয়ে পশুপালন, মাছ,গাভী, ছাগল ও সবজি চাষ করে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যাচ্ছে। অতি দরিদ্র নারীরা ভালো আয় করছে। ড. জিম ইয়ং কিম বলেন, এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে এসডিএফ পরিচালিত দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রাম সমিতি কার্যালয়ে পেঁৗছলে সমিতির সভাপতি হনুফা বেগম তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। পরে সমিতি কার্যালয়ে অর্ধশত সুবিধাভোগী নারী ও যুবকের উপস্থিতিতে এসডিএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এজেডএম শাখাওয়াত হোসেন রাকুদিয়া গ্রামে ‘নবজীবন’ প্রকল্পের কার্যাক্রম সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন।
এরপর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ওই গ্রামে ফরাজী বাড়ির গাভী ও হাস-মুরগির ক্ষুদ্র খামার, মাছ চাষ প্রকল্প, কম্পোষ সার প্রদর্শনী প্রকল্প এবং পতিত জমিতে সবজি চাষ প্রকল্প ঘুরে দেখেন। নবজীবন প্রকল্পের সুবিধাভোগী রাকুদিয়া গ্রামের মো. মিলন হাওলাদার (২২) জানান, এসডিএফ থেকে ৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন। এখন স্থানীয় নতুন হাটে নিজে কম্পিউটার কিনে কম্পোজ ও প্রিন্টের দোকান দিয়েছেন। প্রতিদিন তার কমপক্ষে ৫০০ টাকা আয় হচ্ছে। একই গ্রামের সানিয়া বেগম জানান, প্রশিক্ষণ শেষে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি মাছ চাষ প্রকল্প শুরু করেন ২০১৩ সালে। এখন সানিয়া ৫০ শতাংশ জমিতে তৈরি করা মৎস্য খামারের মালিক।
দক্ষিণ রাকুদিয়া থেকে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট যান উজিরপুর উপজেলার বামরাইল ইউনিয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত ভরসাকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেল্টার পরিদর্শনে। সেখানে তিনি ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে একই গ্রামের গ্রামীণ শক্তি পরিচালিত সৌর বিদ্যুতের সুফলভোগী সত্তার ব্যাপারির বাড়ি পরিদর্শন করেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ভরসাকাঠী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি নারকেল গাছের চারাও রোপণ করেন।
ভরসাকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেল্টার পরিদর্শন শেষে বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও সু-শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাংক সব সময় সহযোগিতা করবে। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এদেশের মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নির্মাণ ও শিক্ষার উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের চলমান সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এই অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প পরিচালক আ. রশিদ খান, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফেরদৌসি আক্তার, স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যাপক এমএ কাসেম, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন উজিরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবাল ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝুমুর বালা। পরে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষ ঘুরে দেখেন এবং ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দঘন কিছু সময় কাটান। পরে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট একই গ্রামের বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় পরিচালিত সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুফলভোগী দরিদ্র সত্তার বেপারির বাড়ি পরিদর্শন করেন।
পৃথক এ দুই কর্মসূচিতে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. মেজবাহউদ্দিন, এসডিএফ চেয়ারম্যান মাইনুল ইসলাম চৌধুরী ও আঞ্চলিক পরিচালক নজরুল আলম সরদার, বাবুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা বেগম ও দেহেরগতি ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান খান।
মঙ্গলবার বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম সকাল সাড়ে ৮টায় বরিশাল বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাকে স্বাগত জানান সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস ও জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান। দুপুর ১২টায় বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট একই হেলিকপ্টারযোগে রাজধানীর উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন।