বাংলাদেশের স্টার্টআপ সংস্কৃতি

তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিবর্তনের পথে সবচেয়ে বড় মাইলফলক হচ্ছে রেডিও ও টেলিফোন আবিষ্কার। এরপর টেলিভিশন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু বড় পরিবর্তন আসে কম্পিউটার আবিষ্কারের পর। আর এর সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত হলে পুরো মানবসভ্যতায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আগে ব্যবহৃত সব মাধ্যমে ধাক্কা লাগে। গতি আসে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে। গতির মাত্রা বৃদ্ধি পায় মোবাইল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর। বর্তমানে তারহীন দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং থ্রিজি ও কোনো ক্ষেত্রে ফোরজি মোবাইল ফোন সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য উন্নয়নে তথা অগ্রগতিতে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং তার সুদক্ষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সেই গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন বলেই ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমাদের সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে চলেছে এবং এগিয়ে যাওয়ার পথেও আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা স্টার্টআপ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত।

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির জয়জয়কার। আমাদের জীবনের চারপাশ যেন প্রযুক্তির এক চাদরে ঘেরা। অনেক সময় অনুধাবন করি আবার অনেক সময় সে চাদরের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি না। তথ্যপ্রযুক্তি আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে মিশে আছে বলেই এর প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় টের পাই না। কিন্তু যখন যোগাযোগ কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের বিচরণে অপ্রতুলতা দেখা দেয়, তখনই আমরা চরমভাবে প্রযুক্তির অভাব বোধ করি। মনে হয়, যেন জীবনটাই নিশ্চল ও বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবেছি, আজকের যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মাধ্যম যেমন গুগল, ফেসবুকের যাত্রা কীভাবে হয়েছিল, কীভাবে এসব মাধ্যমে বেড়ে ওঠা? অথবা কখনও কি ভেবেছি যে, বাড়ির গ্যারেজ কিংবা ভার্সিটির ডরমিটরি থেকে যাত্রা করা কোনো কিছু একদিন পৃথিবী কাঁপাবে? হয়তো ভাবিনি বা ভাবলেও ভাবনার জগতে দীর্ঘ সময় ঠাঁই পায়নি। কিন্তু এটাই সত্যি যে, সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতিসহ জীবনের সব আয়োজনের গতি-প্রকৃতি আজ পরিবর্তিত হয়েছে। বলা যায় পরিবর্তনে আমরা বাধ্য হয়েছি সেই গ্যারেজ ও ডরমিটরি থেকে জেগে ওঠা নিরাকার দানব গুগল ও ফেসবুকের কল্যাণে। ফেসবুক আর গুগল দুটি উদাহরণ মাত্র। এ রকম আরও অনেক পণ্য বা সেবা গড়ে উঠেছে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নিতান্তই অবহেলিত থেকে। কিন্তু পৃথিবীময় আজ সেই অবহেলার পণ্য বা সেবাই যেন আরাধ্য। তাই জোয়ার লেগেছে উদ্ভাবনে, মনোযোগী হয়েছে স্টার্টআপে। দেশে-বিদেশে আজ যেন স্টার্টআপ কোম্পানি কিংবা ব্যক্তির সমাদর বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও আমরা সেই যাত্রায় পিছিয়ে নেই।

বাংলাদেশে স্টার্টআপ ধারণার বিস্তৃতিতে ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৬ আগামীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তথ্যপ্রযুক্তিই যে বর্তমান বিশ্বের চালক তা উবার, এয়ার বিএনবি-এর মতো স্টার্টআপগুলো আবারও প্রতিষ্ঠিত করল। তাই জায়ান্ট কোম্পানি, ইনভেস্টমেন্ট ফার্মস, এমনকি সরকারও আটঘাট বেঁধে নেমেছে স্টার্টআপগুলোকে সহযোগিতা করতে। ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো কয়েকশ’ বিলিয়ন ডলারের তহবিল তৈরি করেছে। দিন দিন এর পরিমাণ বাড়ছেই। বাংলাদেশ স্টার্টআপ ধারণা ২০০৯ সালের আগে সীমিত আকারে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা পূর্ণতা লাভ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ফলে। ২০০৯ সালে রূপকল্প ২০২১-এর ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের সেবা করার সুযোগ পেলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার সে ঘোষণা অনুযায়ী বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। অবকাঠামো থেকে শিল্পের প্রসারে প্রণোদনা প্রদান, সুশাসন থেকে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সব সেক্টরই আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ করেছি, যার প্রদর্শনী হলো ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। আর ডিজিটাল বাংলাদেশের পণ্য ও সেবার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করেছে। বর্তমানে তা গ্রোথ লেভেলে অবস্থান করছে। এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৬ তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উচ্চ গ্রোথের সম্ভাবনাময় সেই স্টার্টআপের প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে যাত্রা করা বেসরকারি স্টার্টআপ আজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে না। আমাদের স্টার্টআপ আজ পেয়েছে মজবুত ভিত্তি। এই মজবুত ও টেকসই ভিত্তি সৃষ্টিতে বরাবরের মতোই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কারওয়ান বাজারস্থ জনতা টাওয়ারে মাননীয় উপদেষ্টা গত বছরের ১৮ অক্টোবর দেশের প্রথম সরকারি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধন করেন। আর এ বছরের ২৭ জুলাই সেই পার্কেই আমরা ৫০ স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, মেন্টরশিপ সুবিধাসহ এক বছরের জন্য বিনামূল্যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি। এই ৫০ কোম্পানির মধ্যে শেষের ৪০ কোম্পানি কো-ওয়ার্কিং স্পেস বরাদ্দ পেলেও প্রথম ১০ প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা স্পেস বরাদ্দ পেয়েছে। সম্প্রতি আমি জনতা টাওয়ারে দু’বার পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। মেধাবীদের মিলনমেলায় গিয়ে আমি বেশ কয়েকটি স্টার্টআপ কোম্পানির তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা বললাম। আমি প্রায় সবারই আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন ও উদ্যম লক্ষ্য করেছি। একজন জানাল, তারা বর্তমানে ভারতের এক স্বনামধন্য স্কুলের সফটওয়্যার ডেভেলপ করছে। অনেক বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সে এই কাজটি করায়ত্ত করতে পেরেছে এবং এই প্রতিযোগিতায় তাকে সহযোগিতা করেছে আইসিটি ডিভিশন বেসিস কর্তৃক আয়োজিত ‘কানেকটিং স্টার্টআপস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা’য় তাদের বিজয়। বিজয়ী হয়েছিল বলেই ভারতের নামকরা সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কুল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার তৈরির কাজটি তিনি পেয়েছেন। আগামী ৩ বছরে তার ডেভেলপকৃত সফটওয়্যারটি পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী ব্যবহার করবে বলে তার বিশ্বাস।

ইতিমধ্যেই আমরা উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করতে এবং উদ্ভাবনকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ইনোভেশন ডিজাইন এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ একাডেমি (আইডিয়া) শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি ২০১১ সালের মধ্যে সব সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনকে সহযোগিতা করতে ‘ওয়ান থাউজেন্ড ইনোভেশন বাই ২০২১’ কর্মযজ্ঞও আমরা পরিচালনা করছি। সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিনির্ভর যে কোনো উদ্যোগকে আইসিটি ডিভিশন ইনোভেশন ফান্ড থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। এ ছাড়া কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, রাজশাহীর বরেন্দ্র সিটি, সিলেটের ইলেকট্রনিকস সিটি, চট্টগ্রামের হাইটেক পার্কসহ সারাদেশে স্থাপিত হতে যাওয়া আরও প্রায় ২০টি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি পার্কেও আমরা ভবিষ্যতে স্টার্টআপদের জন্য ইনকিউবেটর স্থাপন করব। সম্ভাবনাময়ী সব উদ্যোগকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করব।

তথ্যপ্রযুক্তি এমনই এক প্ল্যাটফর্ম, যে প্ল্যাটফর্মে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ একই কাতারে অবস্থান করে। ক্ষেত্রবিশেষে উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশের চেয়েও এগিয়ে থাকে যেমনটি বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ফ্রিল্যান্সিং, ব্লগিংসহ বেশ কয়েকটি সেক্টরে। তথ্যপ্রযুক্তির এই চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন, পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তথ্যপ্রযুক্তির নিয়মই হলো, দিন দিন উৎকর্ষের দিকে ধাবিত হওয়া। যথাসময়ে প্রযুক্তির এই অগ্রগামিতাকে দেশের তথা নিজেদের উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়, না হয় পিছিয়ে পড়ে হতাশা দানা বাঁধে। একটি উদ্ভাবনী চিন্তার অকাল পরিণতি নিশ্চয় আমরা কেউ চাইব না। চাইব না বলেই তোমাদের পাশে থেকে তোমাদের জন্য সরকার কাজ করছে। কাজ করছে বাংলাদেশে স্টার্টআপ কালচার চালু করার মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে আইটি খাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। সে যাত্রায় ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৬ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলেই আমার প্রত্যাশা।

প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ