চোখের সামনেই তরতর করে ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেখেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি। আজ তারা ‘এশিয়ান টাইগারের’ খ্যাতি পেয়েছে। বাংলাদেশে এসে দক্ষিণ কোরিয়ার সেসব দিনের কথা মনে পড়ল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার কাতারে পৌঁছবে বলে মনে হয়েছে তাঁর। এ জন্য বাংলাদেশের জনগণের পেছনে বিনিয়োগ করতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করে ভবিষ্যৎ উন্নয়নযাত্রায় শামিল হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন, আগামী দিনেও এ দেশের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক, সহায়তাও অব্যাহত থাকবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার ওপরও জোর দিলেন তিনি।
আর বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার কাছ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে দেশের অর্জনের প্রশংসা লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টাকে আরো বেগবান করবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের উন্নয়ন প্রয়াসে অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক আরো জোরালো ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি আশাবাদী। এ সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অংশীদারি আরো জোরদারের প্রত্যয়ও জানান তিনি।
বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত পৃথক অনুষ্ঠানে তাঁরা এসব কথা বলেন। এর আগে গতকাল দিনের শুরুতেই সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক শেষে আগামী তিন বছরে বাংলাদেশের জন্য ঋণ সহায়তা ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি শিশুর অপুষ্টি রোধে আগামী দুই বছরে বাড়তি ১০০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দেন তিনি।
দক্ষিণ কোরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক জিম ইয়ং কিম দরিদ্র কোরিয়াকে চোখের সামনেই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছতে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্যানেল আলোচনায় তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার মতো শর্ত পূরণের সক্ষমতাও ছিল না দক্ষিণ কোরিয়ার। কিন্তু দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশে জনগণের পেছনে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আজকের পর্যায়ে এসেছে। জনসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশও কোরিয়ার পর্যায়ে উন্নীত হবে। বিশ্বব্যাংকও সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের মানুষের দক্ষতা ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। ভবিষ্যতেও আমরা সহায়তা অব্যাহত রাখব।’
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের ওই আলোচনায় অন্যদের মধ্যে স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার, বেসরকারি খাতের মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক ও অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির উপস্থিত ছিলেন।
ঘানা সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আলোচনায় বাংলাদেশের মানুষের দক্ষতার প্রশংসা করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘ঘানার একটি শিল্প-কারখানার উৎপাদন ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন একজন বাংলাদেশি। আমরা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এমন উদ্ভাবন শক্তি দেখতে চাই। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।’
জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষগুলো অনেক সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল। যেকোনো কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগাও বাংলাদেশ, উন্নতির বাংলাদেশ।’
মানবসম্পদ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে আরো বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হবে। আর তাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা একত্রে এই যাত্রায় শামিল হতে আগ্রহী। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা উদাহরণ সৃষ্টি করবে।’
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ এটা স্বীকৃতি দিয়েছে যে জনগণের পেছনে বিনিয়োগ তথাকথিত অবকাঠামো, সেতু, সড়ক ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিনিয়োগ মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে কার্যকরভাবে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া ও ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করতে বাংলাদেশকে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভালো মানের অনেক বেশি চাকরির ব্যবস্থা করা এবং জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। এর সঙ্গে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে।
জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে দারিদ্র্যের হার কমিয়েছে, তা আমাদের এই আশা জোগায় যে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য কমার ধারা অব্যাহত থাকবে। অন্য দেশগুলোও বাংলাদেশের কাছ থেকে এই কৌশল অনুকরণ করবে। কিভাবে দারিদ্র্য কমাতে হয় বাংলাদেশ আমাদের শিখিয়েছে। আর তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উদ্ভাবনী। নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণার কারণে অত্যন্ত দ্রুত গরিবের সংখ্যা কমেছে। অবশ্য এখনো অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।’ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমাকে অসাধারণ ও চমৎকার বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, এ দেশের রাজনীতিবিদরা নিজেরা বুঝতে পেরেছেন অতি দারিদ্র্যের হার কমাতে নারীদের ক্ষমতায়ন জরুরি। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে অর্ধেক নারী। অর্থনীতিতে তাদের অবদান ছাড়া বাংলাদেশ কখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পন্ন হতে পারবে না।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাংকপ্রধান বলেন, বাংলাদেশের এখন বৈদেশিক বিনিয়োগ জিডিপির ২ শতাংশেরও কম। অথচ ভিয়েতনামে তাদের জিডিপি ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। সে জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
প্যানেল আলোচনার শুরুতেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘সরকারের প্রধান লক্ষ্য বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে দেশের মানুষ তাদের আজকের সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে সুবিধা ভোগ করতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে স্বস্তিদায়ক করার চেষ্টা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে আমি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। যাঁরা বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের সরকার সুবিধা দেবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক খাত—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি সরকারের অগ্রাধিকার খাত।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে চাহিদা বাড়ানো। তাতে সফলও হওয়া গেছে। এখন দেশের মানুষের মধ্যে বিপুল চাহিদা কাজ করছে। কয়েক বছর ধরে কৃষি উৎপাদনও অনেক বেড়েছে।
তবে বাংলাদেশের অগ্রগতি সত্ত্বেও শিল্প খাতে যথেষ্ট কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভারত অনেক এগিয়ে যাচ্ছে—এমন প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দিয়েছি। গ্রামাঞ্চলে অনেক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে, সেখানেই গ্রামের মানুষ কাজ করছে। দেশের ৫০ লাখ পরিবার রেশন সুবিধা পাচ্ছে, যাদের কার্যত বিনা মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এটি সরকারের ভর্তুকির ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করলেও আমরা এ কাজকে ভর্তুকি বলছি না। এটি জনগণের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেসরকারি খাতনির্ভর। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বেসরকারি খাতের অবদান ৮২ শতাংশ। সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করে তা মূলত বেসরকারি খাতের উন্নয়নকেন্দ্রিক। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার বলেন, পল্লী এলাকা বা গ্রামের মানুষকে ভালো রাখতে হলে সেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে, অবকাঠামোগত সুবিধা ও সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়াকালীন ও এরপর প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এক প্রশ্নে স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী বলেন, নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সরকার সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করেছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নও প্রতিষ্ঠা পাবে। এ জন্য নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালু রাখা হয়েছে। সরকার লৈঙ্গিক বৈষম্য কমাতে পৃথক বাজেট দেওয়া শুরু করেছে, তাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নারীর উন্নয়নে পৃথক বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখছে। মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মোহাম্মদী গ্রুপের এমডি রুবানা হক বলেন, ‘বেসরকারি খাতের বিকাশে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা দূর করতে সরকারের নীতি সহায়তা দরকার। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে সংকট রয়েছে, তবে তা দ্রুত কেটে যাবে বলে আশা করছি আমরা।’
অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সরকার, সুধীসমাজ, এনজিও মিলে সামাজিক খাতের উন্নয়নে কাজ করছে। এতে বাংলাদেশের দক্ষতাও বেড়েছে। বিশেষ করে দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। শিশু অধিকার রক্ষা ও নারীর প্রতি সহিংসতাও কমেছে।
বিশ্বব্যাংকের আরো জোরালো ভূমিকার প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রীর : প্যানেল আলোচনার আগে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত আরেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিদ্যমান অংশীদারিত্ব ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী হবে। বিশ্বব্যাংক আমাদের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। আমাদের এই প্রয়াসে বিশ্বব্যাংক আরো জোরালো ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।
বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার দেশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে মানব-উন্নয়ন সূচকে মধ্যম ক্যাটাগরির দেশ এবং মাথাপিছু আয় বিবেচনায় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি। আমরা বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। ২০২১ সাল নাগাদ তা ৭ বা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চাই। বর্তমানে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা সহসাই স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে আসব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের জনমিতিক সুবিধার সদ্ব্যবহার করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বেশ কিছু হাইটেক পার্ক, সফ্টওয়্যার টেকনোলজি পার্ক প্রতিষ্ঠাসহ বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছি।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়ন ও অর্জনে বাংলাদেশ অন্যতম সফল দেশ হিসেবে বিবেচিত বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এমডিজি বাস্তবায়নের দৃঢ়ভিত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সেগুলো জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করেছি। নির্ধারিত সময় ২০৩০ সালের আগেই এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কম ওজন, খর্বাকৃতি ও অন্যান্য অপুষ্টিজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য মাতৃ ও শিশু পুষ্টি উন্নয়নের লক্ষ্যে এ খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। আমরা জাতীয় পুষ্টি নীতি-২০১৫ প্রণয়ন করেছি। ভবিষ্যতে আমরা পুষ্টিসেবা কার্যক্রম আরো প্রসারিত করতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে বহুবার উল্লেখ করেছি যে বিশ্ব আজ সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদ নামের দুটি অন্যতম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আমার সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে। দেশের জঙ্গিবাদ দমনে আমরা সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদ দমন কার্যক্রমকেও আরো শাণিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের আমলে নানা খাতে উন্নয়ন ও অর্জনের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব আমাদের উন্নয়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এর ফলে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাস্তবায়ন পরিবেশসংক্রান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা জলবায়ু-সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ ও অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।’ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তহবিল থেকে অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে পদ্ধতিগত সংস্কারের ওপর জোর দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নামে একটি তথ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী মুহিত ও বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সন বক্তৃতা করেন। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দীন অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্যরা, সরকারি-বেসরকারি এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ ‘অ্যান্ড পোভার্টি’ শীর্ষক একটি ভিডিও সংগীত পরিবেশন করেন।