হাতের কড়ে গুনে হিসাব কষলে মাত্র কয়েক দিন আগের কথা। বাচ্চার লেখাপড়ার খরচের কথা শুনলেই গর্জে উঠতেন স্বামী নাসির উদ্দিন। ব্যাপারটাও স্বাভাবিক ছিল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারের যেখানে একবেলা খেলে অন্য বেলার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না; ওই পরিবারের সন্তানের আবার কীসের পড়াশোনা? দরিদ্র আর ১০টি সংসারের কুলবধূর মতো কাকলীর জীবনটাও এভাবেই চলে যেতে পারত। কিন্তু তিনি আত্মপ্রত্যয়ে জ্বল জ্বল করছিলেন। বুঝতে চাইছিলেন সুখ কী; দেখতে চাইছিলেন টাকা উপার্জন কতটা কঠিন। পরিশ্রমই সুখের চাবিকাঠি মন্ত্রে উজ্জীবিত এ নারীর একটি উদ্যোগে বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। সঙ্গে সচল হন আরও ৮০ নারী।
উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বড়ালু গ্রামের নাসির উদ্দিনের স্ত্রী কাকলী। টেক্সাইল শ্রমিক নাসিরের সঙ্গে প্রায় ১০ বছর আগে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে সংসারে শুধু অভাব আর অভাবকেই দাবড়ে বেড়াতে দেখেছেন। এরই মাঝে ইভা ও নাঈমা নামে দুই কন্যাসন্তানের মা হন তিনি। বড় মেয়েকে স্কুলে দিতে গিয়েই পড়েন বিপত্তিতে। শুরু হয় নিজের সঙ্গেই বাক্যালাপ। একটা কিছু করতে হবে। আমাকে লড়তে হবে।
তার এ ভাবনার কারণে আজ বড়ালু গ্রামের নারীরা অলস সময় কাটান না। এ গ্রামের প্রতিটি ঘরে নারীদের ওড়নায় কারুকাজ করতে ব্যস্ত দেখা যায়। প্রতিটি নারী কাকলীর কাছ থেকে ওড়নার কাজ আনেন এবং ঘরের কাজের পাশাপাশি ঘরে বসেই মাসে বাড়তি আয় করছেন ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।
কাকলী জানান, ২০১৪ সালে প্রথম ব্র্যাকের ইইপি প্রকল্পের দরিদ্র নারী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে কাকলী ইইপি প্রকল্প থেকে কারচুপির কাজের ওপর পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নারী। আর বঙ্গনারী মানে ওড়নার ব্যবহার থাকবেইÑ এ কারণে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নেন, ওড়নায় কারুকাজের কাজ করবেন। এ কাজে তার স্বামী নাসির উদ্দিন ইসলামপুর থেকে কাকলীকে ওড়নার কাজের অর্ডার এনে দিতেন এবং সুতায় রঙ করে দিতেন। সেই স্বামীই এখন টেক্সটাইলের কাজ ছেড়ে দিয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন। প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার পিস ওড়নার অর্ডার করতে হয়। তাই তিনি তার আশপাশের নারীদের কাজ শিখিয়ে এ কাজগুলো করান। কাকলীর সঙ্গে ৮০ নারী কাজ করছেন। ইসলামপুর থেকে শুধু ওড়নার থান নিয়ে আসেন। সুতা-পুঁথি সব নিজের। প্রতিটি ওড়নার মজুরি ৩০ টাকা। কাজ করিয়ে নেয়া এবং সুতা-পুঁথির খরচ বাদ দিয়েও প্রতিটি ওড়নায় লাভ থাকে ৪ থেকে ৫ টাকা করে। কাকলী প্রতি মাসে অন্তত ৪০ হাজার টাকা আয় করেন বলে নিজেই দাবি করেন।
কাকলীর এ ওড়না ইসলামপুর, সদরঘাট এবং চকবাজারে বিক্রি হয়। এ আয়ের টাকা দিয়ে কাকলী ঘরের খাট, টেলিভিশন এবং ফ্রিজ কিনেছেন। ৭ বছর বয়সী বড় মেয়ে ইভা এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে; আর ছোট মেয়ে নাঈমার বয়স ৪। কাকলীর সংসার এবং বড়ালু গ্রামের নারীদের সংসারে সুখের হাওয়া লেগেছে তার এ ওড়নার কাজ দিয়েই।
গ্রামের বিধবা করিমন নেছা বলেন, ‘বাজান হেয় এই গেরামের বৌ না, আমাগো মাইয়া। হেয় গেরামে এই কাম না আনলে আমি না খাইয়া থাকতাম। অহন কাম করি ভাত খাই। আলাদা একটা ইজ্জত অইছে আমার।’ কাকলী এ কাজ শুরু করেছেন মাত্র ৬ মাস আগে। এখনই সফলতা আর আকাশচুম্বী সুখের হাসি তার ঠোঁটের চিলেকোঠায়। তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সদস্য হয়েছেন। এছাড়া ‘ব্যবসা ব্যবস্থাপনা’র ওপর আরও উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন কাকলী।