কর্মযজ্ঞের আওয়াজ

গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। নিশুতির নীরবতা ভেঙে কানে ভেসে এলো গম্ভীর যান্ত্রিক আওয়াজ। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। দূর থেকে ভেসে আসা ভারী আওয়াজ কিছুটা ভাবিয়ে তুলল। পরক্ষণেই স্বস্তি ফিরে আসে—এ তো আর কিছু নয়, পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ের কাজে নিযুক্ত তিন হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারের আছড়ে পড়ার আওয়াজ।

আমার বাড়ি লৌহজংয়ের হলদিয়ায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে এ আওয়াজ আমার বাড়ি পর্যন্ত আসে। প্রায় প্রতি রাতেই এ রকম আওয়াজ পাওয়া যায়। আশপাশের লোকজন ইতিমধ্যে জেনে গেছে, সেতুর কাজ শুধু দিনেই নয়, সমানতালে রাতেও চলছে।

সেতুর কাজ এখন দিনে-রাতে চলছে। চীনের প্রেসিডেন্টের আগমন চীনা কর্মীদের মনোবল যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেতু তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে কয়েক হাজার কর্মী। তাদের মধ্যে বিদেশি ৪৫৯ জন, অধিকাংশই চীনা। গত শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তাই তাদের মধ্যে বেশ খুশির ভাব ছিল।

শুক্রবার প্রকল্প এলাকায় কথা হয় একজন চীনা প্রকৌশলীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির নিদর্শন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের প্রতীক হয়ে থাকবে এ সেতু।

পদ্মা সেতুর কাজের গতি আরো বাড়াতে দুই হাজার কিলোজুল ক্ষমতার আরেকটি হ্যামারবাহী জাহাজ আসছে। এটি জার্মানির তৈরি। আগামী পরশু জাহাজটির মংলায় পৌঁছার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে এক হাজার টন ক্ষমতার ভাসমান একটি ক্রেন চীন থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এসে পৌঁছেছে। নতুন হ্যামারের জন্য এই বিশাল ক্রেন আনা হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর এটি বন্দরে পৌঁছেছে, এখন কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের কাজ চলছে। এরপর টাগ বোট দিয়ে ক্রেনটিকে টেনে নিয়ে আসা হবে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়ায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায়।

গত সপ্তাহে জাপানের উচ্চপর্যায়ের একটি কারিগরিদল প্রকল্প এলাকা ঘুরে যাওয়ার পর সেতুর কাজের গতি বেড়েছে বহুগুণ। গতকাল শনিবার জাজিরা প্রান্তে সেতুর আরো দুটি পাইল স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৩৭টি পাইল স্থাপন করা হয়েছে। জাপানি প্রকৌশলী সোতমো কানামরি, কনিয়া ওবা ও মাসাকাজু ইয়ামাউচু হাতে-কলমে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের। তিন সদস্যের দলটি চার দিনের সফরে এসেছিল। জাপান থেকে ইকো সাউন্ডার প্রকল্প এলাকায় আগেই আনা হয়েছে। এটির যথাযথ ব্যবহারের কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গেছে কারিগরিদলটি।

চীন থেকে ১৭ হাজার টন স্টিল প্যাডের বিশাল চালান গত বৃহস্পতিবার মাওয়ায় পৌঁছেছে। ৬০ মিলিমিটার পুরু এই স্টিল প্যাড দিয়ে পাইল তৈরি করা হবে। পদ্মা সেতুর জন্য ২৪০টি স্টিলের পাইল লাগবে। এ পর্যন্ত ১৮৫টি স্টিল পাইল (প্রয়োজনের প্রায় ৬৫ শতাংশ) তৈরি করা হয়েছে। ৩৭টি পাইল নদীতে বসানো হয়েছে। এ চালান দিয়ে স্টিল পাইলের আরো ৩০ শতাংশ প্রয়োজন মিটবে।

সংশিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে নদী শাসনের কাজ শুরু হবে। এর কর্মপরিকল্পনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কর্মপন্থা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনুমতি পাওয়ার সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে মাওয়া প্রান্তে নদী শাসনের কাজ শুরু হবে।

পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবে। পর্যটন খাতে যোগ করবে নতুন মাত্রা। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার তিনটি সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। এখন এগুলোর জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। এ মাসেই কাজ শেষ হবে। একেকটি সার্ভিস এরিয়া যেন একেকটি নতুন শহর। মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি সার্ভিস এরিয়া। ১ ও ২ নম্বর এরিয়ায় প্রকল্প ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা থাকছেন। ৩ নম্বর এরিয়ায় থাকছেন সেনা কর্মকর্তারা। এগুলো ঘিরেই পদ্মার দুই পারে গড়ে উঠছে পর্যটন এলাকা। এগুলোর নির্মাণকাজের তদারকি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেতুর কাজ শেষ হলে ৭৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে নির্মিত ২ নম্বর সার্ভিস এরিয়া পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

রাতদিন অবিরাম চলছে পদ্মা সেতুর কাজ। সুপার স্ট্রাকচার জোড়া লাগানোর কাজও এগিয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হতে শুরু করবে। সে লক্ষ্যেই ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলার তৈরি করা হচ্ছে। এগুলোর ওপর দুটি সুপার স্ট্রাকচার স্থাপন করা হবে। মাওয়ার কুমারভোগ ওয়ার্কশপে সুপার স্ট্রাকচারের ফিটিংয়ের কাজ চলছে।

মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সায়েদুল আলম জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, কুমারভোগে একটি চীনা রেস্টুরেন্ট ছিল। কিন্তু প্রকল্প এলাকার বাইরে থাকায় সেটি নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ছিল না। শুক্রবার সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য প্রকল্প এলাকার ভেতরে রেস্টুরেন্ট করা হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের জানান, ওজন কমাতে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে না করে সেতুর মূল অবকাঠামো স্টিল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। বাতাস ও ভূমিকম্পের ধাক্কা সামাল দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। তিনি জানান, প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৩৮ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৩২ শতাংশ।