নকশিকাঁথা বুনে এগিয়ে যাওয়া মোকসেদা

বাড়ির উঠানে বসে সুঁই-সুতার ফোঁড়ে নকশিকাঁথায় নকশা তুলছিলেন মোকসেদা বেগম। নকশিকাঁথার একেকটি ফোঁড়ে তিনি যেন তুলে ধরছেন তার জীবনেরই গল্প। অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছেন। বয়স চৌদ্দ। এই বয়সেই তার অমতে বিয়ে ঠিক করেন বাবা। বাবা মেয়ের বিয়ের মতামত নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। বিয়ের পর মোকসেদা চলে এলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গোবিন্দনগর মুনসিরহাট গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে।

যে বয়সে তার এ গ্রাম ও গ্রাম বেণী দুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা, আর ওই বয়সেই তিনি সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বিয়ের ১০ বছরের মধ্যে তার স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। মোকসেদার বয়স তখন ৪০। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর তার শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয় না। আÍসম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িতেও ফিরে যান না মোকসেদা। স্থানীয় এক এনজিওতে কাজ নেন। চাকরির সামান্য টাকায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন পার করছিলেন তিনি। আর ভাবছিলেন কিভাবে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিশোরী বয়সে সুঁই-সুতার কাজ শিখেছিলেন শখের বশে। সেটাকেই পুঁজি করে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু ভালো কাজের জন্য দরকার প্রশিক্ষণ এবং পরিমিত অর্থ। লোক মারফত জানতে পারেন যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে ছয় মাসের সেলাই প্রশিক্ষণসহ ঋণ প্রদান করে। তিনিও এখান থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন।

এ প্রসঙ্গে মোকসেদা বেগম বলেন, শুরু হল আমার পথচলা। আমার এলাকার ১০ জন অসহায় নারীকে নিয়ে ২০০০ সালে শুরু করি অনন্যা শিল্প নামে ক্ষুদ্র একটি সেলাই কারখানার। নকশিকাঁথা, বালিশের কুশন, মেয়েদের ব্যাগ, বিছানার চাদর, টুপি, মোবাইল ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করি। কাজতো শুরু করলাম, কিন্তু পথটা অতটা মসৃণ ছিল না। একজন নারী ব্যবসা করবে সমাজ এটাকে খুব সহজভাবে মেনে নেয় না। তাও আবার গ্রামীণ পরিবেশে। পরিবার থেকেও সে সময় আমার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। স্বামীও তেমন কোনো সম্পদ রেখে যাননি। ঢাকার বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলার জন্য পণ্য বানানোর মধ্যে দিয়েই পুরোদমে কাজ শুরু করি। দৃঢ় মনোবল ও সাহসই ছিল আমার সঙ্গী। বর্তমানে আমার এই কারখানায় দু’শ নারী কাজ করছেন। এখন মেলার পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন শোরুমে পাইকারি হিসেবে পণ্য সরবরাহ করি। এ ছাড়া বিজিবি বা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দোকানেও আমার পণ্য সরবরাহ করি। এ ছাড়া গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বাড়িতে এসেও আমাদের হাতে তৈরি নকশিকাঁথা, কুশন কাভার, ব্যাগ কিনে নিয়ে যান। ঠাকুরগাঁও শহরে একটি শোরুম দিয়েছি। অনন্যা হস্ত শিল্পের পণ্যের চাহিদা দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে গেছে। আমি নিজেই সরাসরি তাঁতির কাছ থেকে কাপড় কিনে তার ওপর নকশা করি। যার কারণে আমার বানানো পণ্য অন্যদের চেয়ে আলাদা। তবে এ ব্যবসাকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থ ও দিক নির্দেশনার অভাব।

মোকসেদা বেগমের মতে, ব্যবসা করতে হলে কোনো মাধ্যম থেকে পুঁজির ব্যবস্থা করা যাবে, সেটাই জানেন না অনেক নারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিলে টানতে হয় চড়া সুদ। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সেবার তথ্য গ্রামীণ নারীদের মধ্যে সহজভাবে তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু অর্থের জোগান হলেই হবে না। পণ্যের বাজারজাতকরণের পদ্ধতিও জানতে হবে। নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি মোকসেদা বেগম কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। ২০১১ সালে তিনি হস্তশিল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাস রুট উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস বাংলাদেশ মোকসেদাকে দেয় শ্রেষ্ঠ তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলা জয়িতা পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।