চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা পণ্য নামবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে

খোলা পণ্য জাহাজ থেকে নামাতে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথমবার যুক্ত হচ্ছে আধুনিক যন্ত্র ‘নিউমেটিক কনভেয়র বেল্ট’। এই যন্ত্রের সাহায্যে জাহাজের খোপের (হ্যাজ) মধ্য থেকে পণ্যগুলো বেল্টের মাধ্যমে জেটিতে পৌঁছবে। সেখান থেকে আরেকটি মেশিনে ওজন ও বস্তাবন্দি হয়ে সরাসরি জেটিতে থাকা ট্রাকে ওঠানো হবে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছবে। এতে অনেক সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। বর্তমানে সনাতন পদ্ধতিতে জাহাজ থেকে পণ্য নামাতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, এতে পণ্যের দামও বাড়ছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অ্যাডমিন ও প্ল্যানিং) জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে খোলা জাহাজ থেকে পণ্য নামাতে সনাতন পদ্ধতিতে যদি ১০ দিন সময় লাগে তাহলে নতুন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তা তিন দিনে শেষ করা যাবে। এতে একটি জেটিতে বর্তমানের চেয়ে বেশি জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। এতে জাহাজভাড়া বাবদ বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। আর কম সময়ে বেশি জাহাজ ভেড়াতে পারায় বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘আরো আগে এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। এটি বন্দরকে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে। এতে আমদানিকারকের পণ্য খালাসে খরচ অনেক কমবে, সেই সঙ্গে পণ্যের দামও কমার সুযোগ তৈরি হবে।’ তিনি বলেন, বহির্নোঙরে এ ধরনের যন্ত্র যোগ করা হলে পণ্য নামাতে খরচ অনেক কমে আসবে।

বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে থাকা জাহাজ থেকে কনটেইনার নামাতে অত্যাধুনিক ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ ব্যবহার করা হয়। আর যেসব জেটিতে ক্রেন নেই, সেখানে জাহাজে থাকা ক্রেন দিয়ে পণ্য নামানো হয়। কিন্তু খোলা পণ্য জাহাজ থেকে নামানো হয় সনাতন পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে জাহাজের খোপের মধ্যে শ্রমিকরা ঢুকে গম, চাল, ডাল, সরিষাসহ বিভিন্ন পণ্য হাতে বস্তাবন্দি করে সিলিং রুপের (রশি দিয়ে বেশ কিছু বস্তা একসঙ্গে বেঁধে) মাধ্যমে জেটিতে এনে অপেক্ষমাণ ট্রাকে রাখে। সেখান থেকে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যায় এসব পণ্য।

এই পদ্ধতিতে বন্দরে কাজ করছে বর্তমান বার্থ অপারেটররা। একাধিক বার্থ অপারেটর কালের কণ্ঠকে জানান, সনাতন পদ্ধতিতে প্রতিটি জাহাজ থেকে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ দুই হাজার ১০০ টন পণ্য নামানো সম্ভব। আর এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এবং ব্যাগিং ও ওজন পরিমাপের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। এর ব্যতিক্রম হলে এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা সম্ভব হয় না।

বন্দর সূত্র জানায়, সনাতন এই পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক ‘নিউমেটিক কনভেয়র বেল্ট’। প্রাথমিকভাবে একটি যন্ত্র যুক্ত করা হচ্ছে, পরে অন্য জেটিতেও এটি সংযোজন করা হবে। এই পদ্ধতি চালুর জন্য একটি যন্ত্র কিনতে দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পেয়েছে বড়তাকিয়া কনস্ট্রাকশন। বেলজিয়াম থেকে প্রায় সাত কোটি টাকায় এই যন্ত্র সংযোজন করা হবে আগামী দুই মাসের মধ্যে। যন্ত্রটি সরেজমিনে দেখতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি দল আগামী সপ্তাহে বেলজিয়াম যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যন্ত্রটি জাহাজীকরণের পর দেশে আনা হবে, এর পরই সংযোজন করা হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো.আবদুল কুদ্দুস খানের নেতৃত্বে কমিটিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর শাহীন রহমান, প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) নাজমুল হক, নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) নজরুল ইসলাম, সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার আবদুল হান্নান রয়েছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নিজেদের খরচে কমিটির দুই সদস্যের পরিবার নিয়ে বেলজিয়াম যাওয়ার কথা থাকলেও ভিসা না হওয়ায় তাঁরা যাচ্ছেন না।

নিউমেটিক কনভেয়র যন্ত্রটির সরবরাহকারী বড়তাকিয়া কনস্ট্রাকশন কম্পানির কর্ণধার নিয়াজ মোর্শেদ এলিট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী দুই মাসের মধ্যে যন্ত্রটি বন্দরে স্থাপন করা সম্ভব হবে। এর মধ্য দিয়ে খোলা পণ্য খালাসে সনাতন যুগের অবসান ঘটিয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির যুগে প্রবেশ করবে চট্টগ্রাম বন্দর। এতে পণ্য নামানোর ব্যয় বিপুল পরিমাণে কমে আসবে।’ তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এত দিন মনোযোগ ছিল স্বয়ংক্রিয় কনটেইনার পদ্ধতির দিকে। এই প্রথম খোলা পণ্য জাহাজ থেকে নামাতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির একটা পদক্ষেপ নিল বন্দর। এতে কম সময়ে জাহাজ থেকে বেশি পণ্য নামানো সম্ভব হবে, আর বাকি সময়ে আরো বেশি জাহাজ জেটিতে ভেড়ার সুযোগ পাবে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

বন্দর ব্যবহারকারীরা জানায়, একটি খোলা জাহাজে তিনটি হ্যাজ বা খোপ থাকে। বর্তমান নিয়মে তিনটি জাহাজে একসঙ্গে কাজ করলে ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১০০ টনের বেশি পণ্য নামানো সম্ভব হয় না। আর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে প্রতি ঘণ্টায় ১৯০ টন পণ্য নামানো যায়। ফলে ২৪ ঘণ্টায় নামানো যাবে সাড়ে চার হাজার টন। আর ঝড়বৃষ্টিতে সনাতন পদ্ধতিতে পণ্য নামানো বন্ধ থাকে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সব সময় পণ্য নামানো সম্ভব এবং এটি ধুলাবালিমুক্ত ও পরিবেশসম্মত।

জানা গেছে, বর্তমানে এক দিন সাগরে অলস বসে থাকার জন্য জাহাজভেদে প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার গুনতে হয়। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হলে কনটেইনার জাহাজের মতো অনেক কম সময়ে একটি জাহাজ জেটি ছেড়ে যেতে পারবে। এতে বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেশি জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে।