আমি ছোটবেলা থেকে কোরবানির গরু-ছাগল কেনার জন্য পরিবারের মুরব্বিদের সঙ্গে ঈদের বাজারে যাওয়া শুরু করি। এখন পর্যন্ত কোরবানির ঈদে বাজারে গিয়ে গরু-ছাগল কেনা আমার জন্য একটি আনন্দদায়ক ব্যাপার। যে কয়েক বছর কোনো কারণে Ñ হোস্টেলে অথবা দেশের বাইরে ছিলাম, সেই কয়েক বছর ছাড়া প্রতি বছর আমি কোরবানির বাজারে গিয়েছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গত কয়েক বছর দুই-তিন দিন ধরে কোরবানির বাজারে যাই। প্রথম এক-দুই দিন এ-বাজার সে-বাজারে গিয়ে কোরবানির পশুর দাম জানার চেষ্টা করি। কোরবানির এক কিংবা দুই দিন আগে বড় কোনো বাজার থেকে গরু কিনি। সাধারণত বড় বাজার থেকে ছাগল কেনা হয় না। ছাগল ব্যাপারীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দশ-পনেরোটি ছাগল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ক্রেতার অপেক্ষা করে। এসব জায়গা থেকে দরদাম করে ছাগল কিনি। কোরবানির বাজার থেকে কেনা গরুকে বাসায় নিয়ে আসতে বেশ বড় রকমের ঝামেলা পোহাতে হয়। বাজার থেকে রাখাল বালক জোগাড় করতে হয়। এরা সুযোগ বুঝে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দাবি করে। বাসা থেকে দু-একজন লোক নিয়ে যেতে হয়। যারা এই রাখাল বালকদের সঙ্গে মিলে গরুটিকে হাঁটিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। কোরবানির গরু হাঁটিয়ে নিয়ে আসার সময় কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়। পথে পথে লোকজন গরুর দাম জিজ্ঞেস করে এবং অযাচিতভাবে দাম সম্পর্কে মন্তব্য করে। সাধারণভাবে মন্তব্য হচ্ছে, দাম অনুযায়ী গরু ভালো হয়েছে। রাখাল বালক এবং বাড়ি থেকে নেওয়া সাহায্যকারী লোকের হাতে গরু সোপর্দ করে আমরা গাড়ি করে বাসায় চলে আসি। অপেক্ষা করতে থাকি কখন গরু এসে পৌঁছবে। সাধারণত কয়েক ঘণ্টা পর গরু আসে। এ সময়টাতে কিছুটা টেনশন থাকে, লোকজন ঠিকমতো গরু নিয়ে আসতে পারবে কিনা। দু-এক সময় রাস্তা দিয়ে গরু জোরে দৌড় দেয়। ভাগ্য খারাপ হলে ছুটেও যেতে পারে। তখন আশপাশের লোকজনসহ জোর করে ধরে গরু বাগে আনতে হয়। এক কথায় বাজার থেকে কেনা গরু বাসায় নিয়ে আসা বেশ ঝামেলাজনক ব্যাপার। অবশ্য রাস্তা দিয়ে গরু হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া কোরবানির ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির জোয়ান ছেলেরা গরুর সঙ্গে হেঁটে আসে। পথের লোকে দাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। এতে তারা পরিতৃপ্তি অনুভব করে। কোরবানির গরু কাটার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা দরকার হয়। পরিবারের সদস্যরা নিজেরা এ কাজ করতে পারে না। এর জন্য আধাদক্ষ কিছু শ্রমিক অথবা দক্ষ কসাইয়ের প্রয়োজন হয়। যেহেতু এই সময়ে চাহিদা অনেক সে জন্য কসাই পাওয়া একটি কষ্টকর। কসাইরা মাত্রাতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবি করে। পারিশ্রমিক ঠিক হওয়ার পরও তারা যথাসময়ে আসে না। আধাদক্ষ শ্রমিকরা একসঙ্গে কয়েক জায়গায় বায়না নেয়। ফলে তারাও ওয়াদামতো আসে না বা এলেও পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করে না। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি ছুটে বেড়ায়, একসঙ্গে দু-তিন বাড়িতে কাজ করতে চায়, যাতে তাদের আয় বেশি হয়। দক্ষ কসাইরা অবশ্য তেমনটি করে না। এক বাসায় কাজ সম্পন্ন করে অন্য বাসায় যায়। গরুর মূল্য এবং সময় বুঝে তারা পারিশ্রমিক ঠিক করে। পারিশ্রমিক বেশ উঁচুমাত্রায় হয়ে থাকে। যেমন যদি সকালের দিকে মাংস কাটার সিদ্ধান্ত হয় তবে তারা গরুর মূল্যের ২০ শতাংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দাবি করে। যদি দুপুরের দিকে কাজ শুরু করতে হয় তবে পারিশ্রমিক গরুর মূল্যের ১৫ শতাংশ, যদি অপরাহেœ হয় তাহলে গরুর মূল্যের ১০ শতাংশ। সে হিসাবে দেখা যায়, ষাট হাজার টাকা মূল্যের গরু কাটাকুটি করতে ছয় হাজার থেকে বারো হাজার টাকা পর্যন্ত লেগে যায়। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এত টাকা খরচ করা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আধাদক্ষ কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য শ্রমিক পেলে স্বস্তি মিলে। কিন্তু এ ধরনের শ্রমিক জোগাড় করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এমন কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই যেখানে এ ধরনের শ্রমিক পাওয়া যায়। গত বছর থেকে কোরবানির বাজারে একটা নতুন জিনিস আমার চোখে পড়েছে। গতবার আমি পূর্বাচলের হাটে গরু কিনতে গিয়েছিলাম। সেখানে গুটিকয়েক ‘মিনিট্রাক’ আমার চোখে পড়ল। এগুলোর সংখ্যা সব মিলিয়ে সাত-আটটি হবে। মিনিট্রাকগুলোতে দু’পাশে বাঁশ লাগিয়ে গরু বহন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাটি আমার কাছে অভিনব মনে হয়েছে। তবে এই মিনিট্রাক বা পিকআপের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় গরু বহন করার ভাড়া একটু বেশি দাবি করা হচ্ছিল। সে জন্য গত বছর আমি এই ব্যবস্থায় গরু বহন করতে সম্মত হইনি। অন্যান্য বছরের মতো বাসার লোকের মাধ্যমে রাখাল দিয়ে কেনা গরুটি বাসায় নিয়ে এসেছি। তবে বাসার লোক জানিয়েছে, গরু হাঁটিয়ে আনতে বেশ কষ্ট হয়েছে। কারণ কুড়িল ফাইওভার এবং ফুটওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে গরু হাঁটিয়ে আনা নিষেধ ছিল। এদিকে এয়ারপোর্টের রাস্তার ডিভাইডার মাইলের পর মাইল কাটা না থাকায় বহুপথ ঘুরে গরু বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। কাজটি বড় রকমের কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার পূর্বাচলের গরুর বাজার গতবারের বাজার থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশে বসানো হয়েছিল। গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত হওয়ায় ‘হাসিল’ শতকরা দুই ভাগ কম ছিল। ঢাকা শহরের বাজারে হাসিল ৫%, গ্রামের বাজারে তা ৩%। অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা গরুর দাম হলে হাসিল বাবদ সাশ্রয় হয়েছে এক হাজার টাকা। এবার দেখলাম দুই-তিনশ মিনিট্রাক, পিকআপ গরু বহন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। নিম্নবিত্ত কিশোর চালকরা উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে কোরবানির গরু বহনকে একটি অর্থকরী কর্মকা- হিসেবে প্রচলন করেছে। প্রত্যেকটি মিনিট্রাক, পিকআপের দুপাশে গত বছরের চেয়ে উন্নতভাবে বাঁশ লাগানো হয়েছে এবং গরু তোলার ব্যবস্থা সহজ করা হয়েছে। সংখ্যা বেশি থাকায় বাহনের ভাড়াও যৌক্তিকভাবে কমে এসেছে। আমরা ৬০০ টাকায় একটি পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে গরু এনেছিলাম। সঙ্গে রাখালের কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুধু আমার বাসার লোক গরুর সঙ্গে পিকআপ ভ্যানে উঠে গেল। আমরা আগের মতো গাড়িতে উঠে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। হাসিল বাবদ আটশ টাকা সাশ্রয় হয়েছিল। আমি যখন গাড়ি করে বাসায় আসলাম ততক্ষণে গরু বাসায় পৌঁছে গেছে। বাসার সহযোগীদের তেমন কষ্ট হয়নি। পিকআপ ভ্যানে গরুর সঙ্গে তারা চলে এসেছে। তাৎক্ষণিক সুবিধা ছাড়া দেশি কিশোরদের উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। আমি চিন্তা করে দেখলাম, এই মিনিট্রাক পিকআপ ভ্যানের ব্যবহারের ফলে ঢাকা শহরের জনবহুল স্থানে কোরবানির হাট বসানোর প্রয়োজন নেই। হাটগুলো সহজেই শহরতলিতে যেখানে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রয়েছে সেখানে বসানো যেতে পারে। পশু কেনার পর সীমিত খরচের মধ্যে পশুকে দশ-পনেরো কিলোমিটার বহন করে আনা যেতে পারে। গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত হাটে যে পরিমাণ টাকা হাসিল বাবদ সাশ্রয় হয় তার একাংশ দিয়ে পশু বহনের খরচ মেটানো যাবে। এতে শহরের পরিবেশ নষ্ট হবে না। পক্ষান্তরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব আসবে। সেখানের লোকজন বাড়তি কাজ করার সুযোগ পাবে। দেশি কিশোরদের এই উদ্যোগ প্রশংসার্হ। সুযোগ পেয়ে আমাদের দরিদ্র কিশোররা এ কাজে এগিয়ে এসেছে। এটাই আশাব্যঞ্জক। এবার কোরবানির হাটে আরও একটি ব্যাপার চোখে পড়ল। দেখলাম কিছু শিক্ষিত কিশোর তাদের ‘পরিচিতি কার্ড’ হাতে নিয়ে বিতরণ করছে। তারা জানাচ্ছিল, তাদের হাতে দক্ষ-আধাদক্ষ কসাই, শ্রমিক রয়েছে যাদের কোরবানির দিন গরু কাটাকুটির কাজে লাগানো যেতে পারে। কার্ডে তাদের নামধাম, মোবাইল ফোন নম্বর রয়েছে। কসাই কিংবা আধাদক্ষ শ্রমিকদের জোগাড়ের জন্য ঘুরে ঘুরে যারা কান্ত হচ্ছেন, তারা স্বস্তির সঙ্গে এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারেন। আমার ধারণা এ সুযোগ ব্যবহার করে অনেকে স্বস্তি পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এরূপ মৌসুমি ব্যবসা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করি। দেশের নিম্নবিত্ত কিশোরদের এ ধরনের উদ্ভাবনীমূলক কাজে উৎসাহিত করার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এ রকম ছোট ছোট উদ্ভাবনী কাজের মাধ্যমে দেশের অনেক সেক্টর এগিয়ে যায়। এই উদ্যোগকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা সমীচীন হবে না। সমর্থন পেলেই এই শ্রেণির নিম্নবিত্ত কিশোররা আরও উদ্যোগী হবে, তারা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান