মানুষের চুল এখন রপ্তানি পণ্য। চুল রপ্তানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রার আয় প্রতি বছরই বাড়ছে। গত অর্থবছরে মানুষের চুল ও চুল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১৪০ কোটি টাকা আয় হয়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ১৫২ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চুল রপ্তানির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চুল সংগ্রহের বড় বাজার। এসব চুল সেলুন ও বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করা হয়। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি। বর্তমানে চিন, জাপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ায় চুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এগুলো দিয়ে পরচুলা, কৃত্রিম চুল, চোখের ভ্রু তৈরি হয়। বাংলাদেশে এসব পণ্য তৈরির চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান চুলের তৈরি পণ্যও রপ্তানি করছে। সূত্র জানায়, আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চুল যেত চোরাই পথে। সেখান থেকে চিনা ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন। ২০০০ সালে চিনের ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চুল কিনতে আগ্রহী হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় দেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে চুলের বাজার গড়ে ওঠে। মূলত চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চুলের বাজার। এ ছাড়া সাতীরা, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে চুল বিকিকিনির ব্যবসা গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন আকারের চুল নিয়ে এসব স্থানে বিক্রি করেন হকাররা। তারা সংগ্রহ করেন সেলুন ও বিউটি পার্লার থেকে। এগুলোর চাহিদার কথা বিবেচনা করে সেলুন ও বিউটি পার্লারগুলো এখন চুল সংগ্রহ করে রাখে। ব্যবসায়ীদের কাছে সব চুলের কদর নেই। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি। কারণ এগুলো দিয়ে পরচুলা তৈরি হয়। প্রথমে এগুলো শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ভালো করে শুকানো হয়। পরে আকার ও মান অনুসারে আলাদাভাবে প্যাকেজ করা হয়। এরপর বিক্রি করা হয় গ্রেড অনুসারে। ক্রেতারা সাধারণত ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা চুল ক্রয় করেন। তবে চুল যত লম্বা হয়, দামও তত বেশি। প্রক্রিয়াজাত করা চুল গ্রেড অনুসারে প্রতিকেজি ৭ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮৫ লাখ ২১ হাজার ডলারের চুল রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ডলার (প্রায় সাড়ে ৮৬ কোটি টাকা)। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ২০ কোটি টাকার। আর বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার বা ১৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা ১৫২ কোটি টাকা। চুল ব্যবসায়ী আতাউর রহমান বলেন, চুলের বড় ক্রেতা চিন। বাংলাদেশ ও ভারত থেকেই তারা মূলত চুল সংগ্রহ করার পর রপ্তানি করে। সেগুলো থেকে নানা পণ্য তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। তিনি আরও বলেন, চুল রপ্তানির বিষয়টি এখনো পৃথক একটি শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তবে এটি সম্ভাবনাময় একটি খাত। ব্যাংকের ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা পেলে এ খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ইপিজেডের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপ (বেপজা) জানিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে মানুষের ফেলে দেওয়া চুলে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে সেগুলো রপ্তানি শুরু করেছে ৪টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তিনটিই চিনাদের মালিকানাধীন। উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস, ঈশ্বরদীতে এমজেএল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ও মংলায় ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ। এর বাইরে গাজীপুরেও একটি পরচুলা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের পরচুলা তৈরি করে সেগুলো রপ্তানি করছে। প্রাইস মেশিন নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, আমেরিকার বাজারে মানভেদে পরচুলার খুচরা মূল্য ১০ ডলার থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত। দেশ ও মানভেদে দামের রকমফের রয়েছে। পরচুলা, ভ্রু ও চোখের পাতার কৃত্রিম লোমের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।