স্বাভাবিক হচ্ছে শেয়ারবাজার

২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার সাড়ে পাঁচ বছর পর অনেকটাই থিতু হয়ে এসেছে দেশের শেয়ারবাজার। চলতি বছরে গুটিকয়েক শেয়ার ছাড়া তালিকাভুক্ত সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদরে উল্লেখযোগ্য উত্থান ছিল না। আবার বড় ধরনের পতনও ছিল না। ফলে ‘লোকসান দিয়ে বাজার ছাড়ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা’_ এমন খবর এখন আর শোনা যায় না; বরং নতুন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আসছেন অনেকে। স্বাভাবিক হচ্ছে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

দরপতনের ভীতি না থাকায় ক্রমে শেয়ার চাহিদা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে বাজার সূচক। গতকাল মঙ্গলবার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এক বছর পর আবার ৪৭০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২-৩ বছরে ব্যাংক আমানত ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ব্যাপক হারে কমেছে। এ কারণেও শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে কখনও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেননি, এমন অনেকে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে শেয়ারবাজারে আসছেন। পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে হলেও বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগ। এসব কারণে শেয়ারবাজার ধীরে ধীরে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

দেশের দুই শেয়ারবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই ও সিএসই) সাম্প্রতিক লেনদেন পর্যালোচনায়ও বাজারের গতি স্বাভাবিক হয়ে আসার ইঙ্গিত মিলছে। ক্রমে

বাড়ছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ। গত বছরের শুরুতে যেখানে দৈনিক গড়ে শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে ২০০ কোটি টাকার, চলতি বছরের শুরুতেই তা ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে ৬৮১ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যা গত আট মাসের সর্বোচ্চ। দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতে শেয়ার কেনাবেচাও এক বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে।

এ ছাড়া ২০১০ সালের ডিসেম্বরের পর গত ছয় বছরের সার্বিক লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত দুই বছরের বার্ষিক হিসাবে যে ক’দিন বাজারে সার্বিক শেয়ারদর কমেছে, প্রায় সমানসংখ্যক দিনে বেড়েছে শেয়ারদর। লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে ৬৫৫ কার্যদিবস ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ৭০৭ কার্যদিবসে। তবে ২০১১ সালে সূচক কমেছিল ৩০৪৭ পয়েন্ট, ২০১২ সালে কমে ১০৩৮ পয়েন্ট। পরের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বেড়েছে যথাক্রমে ২১০ ও ৫৯৮ পয়েন্ট। ২০১৫ সালে এসে সূচক কমে ২৩৫ পয়েন্ট। আর চলতি বছরের ১৮৩ কার্যদিবসে বেড়েছে ৭৯ পয়েন্ট। এ সময়ে ৯২ দিন সূচক বেড়েছে, বিপরীতে কমেছে ৯১ দিন। পরিমাণে খুব বেশি না হলেও গত ৩১ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১৩ কার্যদিবস ডিএসইর সূচক বেড়েছে, যা স্মরণকালের রেকর্ড। আবার সূচকের অস্বাভাবাবিক উত্থান-পতনও থেমেছে, যা শেয়ারদরের স্থিতিশীলতাকে ইঙ্গিত করছে।

অবশ্য বার্ষিক মুনাফার নিরিখে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কোম্পানির শেয়ারদর যৌক্তিক দরের অনেক নিচে অবস্থান করছে এখনও। বিশেষত ব্যাংক ও বস্ত্র খাতের শেয়ারগুলোর বাজারদর এখনও অনেক কম। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত শেয়ারগুলোর দর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, (গত এক মাসে কিছুটা দরবৃদ্ধির পরও) তালিকাভুক্ত ২৯৪ কোম্পানির মধ্যে ৩৪টির শেয়ার অভিহিত মূল্য বা এর নিচে অবস্থান করছে। সর্বোচ্চ ২০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে ১১৪ কোম্পানির শেয়ার। অভিহিত মূল্য ১০ টাকার তিন গুণ দরে কেনাবেচা হচ্ছে ১৫৫টি, পাঁচ গুণ পর্যন্ত দরে কেনাবেচা হচ্ছে ১৮৯টি এবং অভিহিত মূল্যের তুলনায় ১০ থেকে ২৫২ গুণ বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে ৬৬ কোম্পানির শেয়ার।

দেশের শেয়ারবাজারের অন্যতম প্রধান ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের সিইও খায়রুল আনাম সমকালকে বলেন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে বিভিন্ন শেয়ারের যে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি হয়েছিল মূলত ২০১১ ও ২০১২ সালের দরপতনেই তা সংশোধন হয়েছে। পরের দুই বছরও নানা ইস্যুতে সৃষ্ট গুজবে বাজারে কিছুটা অস্থিরতা ছিল। ২০১৫ সালে সে অস্থিরতাও কমেছে। এ বছর বাজার অনেকটা স্বাভাবিক। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি ছিল, তাও কেটে গেছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে খায়রুল আনাম আরও বলেন, মানুষের কাছে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে। কয়েক মাস ধরে নতুন অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে আসছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ২০১০ সালের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির সময়ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেননি। অর্থাৎ মানুষ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন। অস্বাভাবিক মুনাফার লোভ করছেন না। কিছুটা মুনাফা পেলে শেয়ার বিক্রি করছেন। এতে শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কমেছে। শেয়ারবাজারে অন্ধের মতো বিনিয়োগ করা মানুষের সংখ্যাও কমছে।

নতুন বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আসার কারণ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইফতেখার-উজ-জামান সমকালকে বলেন, দরপতনের পর অনেক শেয়ারের দর গ্রহণযোগ্য দরের তুলনায় নিচে আছে। এটা মানুষ বোঝে। তারা মনে করছে, এখনকার বাজারদরে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি অনেক কম। আবার একই সময়ে ব্যাংক ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমে যাওয়ায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছেন অনেকে।

ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমানও এমনটাই মনে করেন। তিনি সমকালকে বলেন, গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারের আইন-কানুনে ব্যাপক সংশোধন হয়েছে। বিশেষত স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা বিভাগ থেকে মালিকানা বিভাগ পৃথক্করণ (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) বাস্তবায়ন হওয়ায় বাজার পরিচালনায় স্বচ্ছতা বেড়েছে। সব শেয়ার কেনাবেচা ইলেট্রনিক ফর্মে হওয়ায় সর্বত্র তার রেকর্ড থাকছে এবং অত্যাধুনিক সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাজারে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। ফলে কারসাজি প্রায় বন্ধ হয়েছে। এসব কারণেও শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরছে মানুষের। তারা আগ্রহী হচ্ছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে।

বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরাও মনে করেন, ২০১১ ও ২০১২ সালের ধসের ধকল অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে শেয়ারবাজার। তবে ওই ধসের বড় লোকসান এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে তারল্য প্রবাহ বা শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। এতে বাজারও কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। নতুন করে তারল্য প্রবাহ বাড়ানো গেলে বাজার আবারও গতিশীল হবে বলে মনে করেন তারা।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, শেয়ারবাজারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট ছিল এখন আর তা নেই। তিনি বলেন, সব খারাপের একটা শেষ আছে। শেয়ারবাজার ধসের যে ধকল এখন তা আর নেই। মানুষের কাছে টাকা আছে। মুনাফার প্রত্যাশায় শেয়ারবাজারে আসতে শুরু করেছেন তারা।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত দুই কোটি মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষমতা রাখেন। অথচ শেয়ার কেনাবেচা করেন এমন মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি নয়। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষ (যারা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন) মনে করেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার মানে টাকা খোয়ানো। এখানে জুয়াড়িরা টাকা মেরে দেয়। মানুষের এ ভুল ধারণা ভাঙানো গেলে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব।

বিশ্লেষকরা অবশ্য এও বলছেন, শেয়ারবাজারে সার্বিক সুশাসনে এখনও কিছুটা ঘাটতি আছে। বিশেষত ‘৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালের শেয়ার কারসাজির হোতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সর্বশেষ কারসাজির ঘটনায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পুনর্গঠিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই কারসাজির হোতাদের খুঁজে পেতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এটা করা গেলে মানুষের মধ্যে আস্থা আরও বাড়ত বলে অনেকে মনে করেন।

আবার বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের সিংহভাগ উদ্যোক্তাকে এখনও শেয়ারবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে আগ্রহী করা যায়নি। বিশেষত বাজারে সুশাসনের অভাব আছে_ এমন অজুহাতে বড় শিল্প গ্রুপ ও বহুজাতিক বহু কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না। শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে_ এমন ৩০ হাজার কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৩০০টি শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করছে। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরও প্রায় ৪০ কোম্পানির শেয়ার বিক্রির কথা গত আট বছর ধরে বললেও এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই, যা বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোক্তাদেরও শেয়ারবাজারে আসতে নিরুৎসাহিত করছে। দেশের অর্থনীতির নানা সূচকে বেশ ইতিবাচক ধারা থাকলেও দেশের শেয়ারবাজারের অবদান অর্থনীতিতে এখনও অনেক কম। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই, সার্কভুক্ত দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার তুলনায়ও দেশের শেয়ারবাজার অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে আছে।

সম্প্রতি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, শেয়ারবাজারকে দেশের মানুষের কাছে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে না। ফলে এখানে বিনিয়োগ করার জন্য সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ কম।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, বাজার এখন স্বাভাবিক। তবে ২০১১ সালের ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের হিসাবে বড় ধরনের মূলধনী লোকসান আছে। এ কারণে মার্জিন ঋণ নেওয়া কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। আবার মার্জিন ঋণ কয়েক বছরেও ফেরত না পাওয়ায় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। এ সংকট সমাধান করা গেলে শেয়ারবাজার আরও গতিশীল হতো। শেয়ারদর আরও কিছুটা বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা লোকসানও পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেত। এ সমস্যা সমাধানে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় সরকারের কাছে ছয় হাজার কোটি টাকার ঋণ চাওয়া হয়েছে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা বাড়ছে বলেই ডিএসইর শেয়ার কিনতে এক ডজন বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর অর্থ, আমাদের শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি আইনি দিক তদারকি করা ছাড়াও বাজারের সার্বিক উন্নয়নে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করছে। বাজারের উন্নয়নে ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কারও কোনো প্রস্তাব থাকলে তা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বিএসইসি।