‘বাকবাকুম পায়রা/ মাথায় দিয়ে টায়রা/ বউ সাজবে কালকি/ চড়বে সোনার পালকি’_ ছোটবেলায় বাবা আবদুস সাহিদের মুখে শুনতে শুনতে ছড়াটি মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল শ্রীপুরের শেখ সফিকুর রহমানের। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের লেখা এ ছড়া শুনতে শুনতেই বাবার কাছে সফিক বায়না ধরেছিলেন, কবুতরের ডাক শুনবেন। ছেলের বায়না উপেক্ষা করতে পারেননি বাবা। সাত টাকা দিয়ে বাজার থেকে ছেলেকে কিনে এনে দিয়েছিলেন একজোড়া কবুতর। পরম যত্নে সেগুলো পালন করতে শুরু করেন সফিক। এভাবেই কবুতরের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা গড়ে ওঠে তার। ঘুম ভাঙত কবুতরের মায়াময় ডাকে। রাতে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন কবুতর যুগলকে রাখতেন শিয়রের পাশে। একজোড়া কবুতর মাত্র নয় বছরের বালক সফিকের সামনে খুলে দেয় নতুন জগৎ। সেই জগৎকে খানিকটা হলেও উপলব্ধি করা যায় এখন শ্রীপুরে গেলে। বিশাল এক কবুতরের খামার গড়ে তুলেছেন সফিক। দেশি-বিদেশি শতাধিক জাতের প্রায় সাতশ’ কবুতর আছে খামারটিতে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশের কবুতর পালন করছেন তিনি। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মুলাইদ গ্রামে (মাওনা চৌরাস্তা এলাকা) সফিকুর ২০০৬ সালের গোড়ার দিকে আম-কাঁঠাল গাছে আচ্ছাদিত বাড়ির উঠানে কবুতরের এই রাজ্য গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।
কবুতরের প্রতি দুর্বলতা থেকে এর লালন-পালন নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন শেখ সফিকুর রহমান। লেখাপড়ার পাশাপাশি কবুতর সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য বিভিন্ন এলাকায়ও ঘোরাঘুুরি শুরু করেন তিনি। এলাকার লোকজন তার এই কবুতরপ্রীতিকে ‘পাগলামি’ মনে করতেন। তবে মা রাজিয়া বেগম ও বাবা প্রয়াত আবদুস সাহিদ তাকে কখনও বাধা দেননি; বরং বিভিন্ন এলাকা থেকে
ছেলের সংগ্রহ করা নানা জাতের কবুতর দেখে আনন্দই পেতেন তারা। টাকা-পয়সাও দিতেন কবুতর কিনতে। একসময় সফিক বাড়ির উঠানে কবুতরের রাজ্য গড়ার
স্বপ্নে বিভোর হন। ২০০৬ সালে শুরু করেন সেই রাজ্য গড়ার কাজ। বাড়ির চারদিকে তৈরি করেন কবুতরের জন্য বিশেষ আশ্রয়। শুরু করেন বিশ্বের বিভিন্ন জাতের কবতুর সংগ্রহ করার কাজ। ১০ বছর ধরে তিনি সংগ্রহ করেছেন ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, জাপান, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, সৌদি আরব, ইরাকসহ ৫০টি দেশের শতাধিক জাতের কবুতর। এসব জাতের মধ্যে রয়েছে হলুদ ফ্রেন্ডস মুন্ডিয়ান, আমেরিকান হেলমেট, ইউরোপিয়ান হেলমেট, হলুদ স্নো টামলার, হলুদ পলিশ আওল, হলুদ শেটেল আওল, হলুদ মার্কস টামলার, বুলগেরিয়ান আওল, হলুদ বাটারফ্লাই, ইউরোপিয়ান করমোনা, হলুদ শর্টপিস, হোয়াইট অ্যাঞ্জেলস, জেফুবিন, হলুদগোলি, গিরিবাজ, ঘরগিরিবাজ, লোটন, মুক্ষি, লক্কা, সিরাজি, বলকবুতর, হোমার, ককুয়া, কিং, মডেনা, কার্নি, জফ, ট্রামপিটার, ম্যাগপাই, ব্লু হেনা, লাল হেনা ইত্যাদি জাতের কবুতর। লাল, নীল, শাদা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের প্রায় সাড়ে তিনশ’ জোড়া কবুতর রয়েছে তার খামারে। আট হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা দামের কবুতর রয়েছে তার খামারে। তিনি যেমন উচ্চ মূল্য দিয়ে বিদেশ থেকে কবুতর নিয়ে আসেন, ঠিক তেমনি তার খামারের কবুতরগুলোও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিকোয় চড়া মূল্যে। কবুতর পালনের পেছনে তার প্রতি মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি। বিদেশি জাতের কবুতরগুলোর বাচ্চা বিক্রি করে তার প্রতি মাসে লাভ হয় অন্তত তিন-চার লাখ টাকা। খামারে চার-পাঁচজন শ্রমিক কাজ করেন তার সঙ্গে। প্রাণিচিকিৎসক ডা. রঞ্জিত কুমার তার কবুতরগুলোকে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
শুরু হয়েছিল শখের বশে, পরে তা পরিণত হয়েছিল নেশাতে। কিন্তু এখন শুধু শখ বা নেশা নয়, অনেকটা বাণিজ্যিকভাবেই কবুতর পালন করছেন তিনি। কবুতরের দিকে একনজর তাকিয়েই তিনি বলতে পারেন, অসুখ করেছে কি-না। কিংবা স্ত্রী কবুতরটি আর কতক্ষণ পরে ডিম দেবে। তার দিনের শুরুই হয় কবুতরগুলোকে আদর আর যত্ন করার মধ্য দিয়ে। ভোরে কবুতরগুলো ডাকাডাকি শুরু করলে সফিকও উঠে পড়েন বিছানা থেকে।
শেখ সফিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘কবুতর নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি, মানুষকেও স্বপ্ন দেখাই। কবুতর পালনে অন্যকে উৎসাহিত করি। দেশের সবচেয়ে বড় কবুতর খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে আমার মাথায়। কাজও করছি সেই চিন্তা থেকে।’