মুষ্টির চালে স্কুলের টিফিন

দুপুরের তপ্ত রোদে বিদ্যুৎহীন একটি টিনের চালার কক্ষে বসে বিরক্তি ভাব ছিল না শিশু সায়মার মুখাবয়বে। আরেকটু পরেই শেষ ঘণ্টা। তারপর স্কুলে বসেই হবে আজকের টিফিন। তার সহ সব সহপাঠীর জন্য স্কুল আঙিনায় সায়মার মা শাহিনুরসহ আরো অনেকেই টিফিনের জন্য রান্নাবান্না করছেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া সায়মার মতোই চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খুঁজে পাওয়া গেল সব শিশুর চেহারায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল আয়োজন করেছে ব্যতিক্রম এক উদ্যোগ। স্কুলেপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মায়েদের সপ্তাহের সংগ্রহ করা মুষ্টিচালে প্রতি শনিবার দুপুরে খিচুড়ি মাংস। এই রান্নাবান্নার আয়োজকও অভিবাবকরাই। এছাড়া পুরো বিদ্যালয়ের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীদের রোজকার টিফিনে দেয়া হয় কলা-রুটি। বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বড় ডেকচিতে রান্না করা হয় খিচুড়ি। কোমলমতি শিশুদের পুষ্টির কথা ভেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিবাবকেরা মিড ডে-তে মিলিত হয়ে এ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের মায়েদের দেয়া মুষ্টিচাল আর স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় গত দু’বছর ধরে ভুনা খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। রান্নায় ৮ জন অভিভাবকের (শিক্ষার্থীদের মায়েরা) একটি দল ও বাবুর্চি ব্যস্ত থাকে। উৎসবমুখর এ দৃশ্যটি স্থানীয় ব্রাইট শিশু কানন নামে একটি বেসরকারি স্কুলের। বিদ্যালয়ের প্রতি শনিবারের এ আয়োজনে স্থানীয় কৌতূহলি মানুষের পাশাপাশি আশপাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপস্থিত থাকেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করতে হয় শিক্ষার্থীদের। টানা প্রায় ৬ ঘণ্টায় ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। অজপাড়াগাঁয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি এ বিদ্যালয়টিতে প্রতিদিন কলা-রুটি দেয়া হতো। কলা-রুটি খেতে খেতে শিশুদের মনে একঘেয়েমি চলে আসে। অনেকে খায়, আবার অনেকে খায় না। ক্ষুধায় কাতর শিক্ষার্থীদের কষ্ট আর শারীরিক বিকাশে প্রয়োজনীয় পুষ্টির কথা ভেবে উদ্যোগ নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক মায়েদের নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। এরপরই ২০০ শিক্ষার্থীর অভিভাবক মা, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটি এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন।
মায়েরা পরিবারের প্রতিদিনের রান্নার চাল থেকে এক মুষ্টিচাল বাঁচিয়ে জমা করেন। জমা হওয়া চাল সপ্তাহ শেষে পৌঁছে যায় স্কুলটিতে। আর স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটি নিজেরা কিনেন লবণ, তেল, লাকড়ি ও প্রয়োজনীয় মসলাপাতি জানালেন আমেনা বেগম নামের এক মা। আরেক অভিভাবক মুশরাত সুলতানা বলেন, ৮ জন করে একেকটা দল করেছি পর্যায়ক্রমে রান্না ও পরিবেশন করে খাওয়ানোর জন্য। এই দলটি প্রতি মাসে পরিবর্তন হয়। বাড়তি চাল বিক্রি করে সাপ্তাহিক কলা রুটি কিংবা অন্য কোনো টিফিনের আয়োজন করা হয়।
সরজমিন দেখা যায়, শনিবার দুপুর ১টার সময় বিরতির ঘণ্টা বাজতেই শুরু হয় হইচই। কে কার আগে থালা-বাসন আর গ্লাস নিয়ে বসবে চলে তার প্রতিযোগিতা। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিশুদের হাত ধোয়ার প্রতিযোগিতাও চালায়। হাত ধোয়া ছাড়া কেউ খেতে বসে না। শিক্ষক আর মায়েরা তাদের খাওয়ান পরম মমতায়। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জিসান মোল্লা বলে, খুব মজা লাগতাছে খিচুড়ি খাইতে। ডেলি কলা-রুটি ভাল্লাগেনা। শিক্ষার্থী উষ্ণতা, সিনথিয়া, নাদিয়া, বলে, কলা-রুটি খাই প্রতিদিন। একদিন খিচুড়ি খাইতে মজাই লাগে।
গত দু’বছর ধরে প্রতি শনিবার মায়েদের মুষ্টিচালে শিশুদের খিচুড়ি খাওয়ার ব্যতিক্রমী কার্যক্রম চলছে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি খন্দকার ইউনুছ, অভিবাবক সদস্য মামুন মিয়া, আক্তার হোসেন, আওলাদ হোসেন, আনোয়ার হোসেনসহ আরো অনেকেই বলেন, শিশুদের পুষ্টি ও শারীরিক বিকাশের কথা ভেবেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, শিশুদের যত্নবানের পাশাপশি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা নিয়ে র‌্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে ব্রাইট শিশু কানন স্কুল।
এ ব্যাপারে স্কুলের পরিচালক রায়হানা সুলতানা কণা বলেন, যদিও স্কুলটি অজপাড়াগাঁয়ে। অনেক ছাত্রছাত্রীই গরিব। সবার সহযোগিতায়ই স্কুলটি চলে। শিশুদের শারীরিক বিকাশে খিচুড়ি সপ্তাহে তিনদিন খাওয়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। শিশুদের মেধা বিকাশে স্কুলে আরো কর্মসূচি নেয়া হবে। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের সভাপতি হাবিবুর রহমান হারেজ বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলটি যে ধরনের ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তা উপজেলা অনেক স্কুলে চালু করার কথা ভাবছি আমরা। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ শফিকুর রহমান সরকার বলেন, নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। বেসরকারি একটি স্কুলের এ উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে।