কলসিন্দুরের আলোই ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে

বছরখানেক আগে খেলাধুলায় বেশ এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ক্রিকেটেই সাফল্য সবচেয়ে বেশি এসেছিল। সেখানে ফুটবল, হকি, সাফ গেমস, এসএ গেমস, এএফসি, এমনকি অলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্টে বালাদেশের সাফল্য একেবারে কম ছিল না। এ সময়ের মধ্যে আমরা অজপাড়াগ্রাম কলসিন্দুরের একঝাঁক তরুণী ফুটবলার পেয়েছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লড়ার জন্য। এরই মধ্যে আমরা আরও পেয়েছি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নতুন সম্ভাবনাময় বিস্ময় ‘সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস’ নামে খ্যাত মুস্তাফিজকে। প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশে ক্রিকেটের কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের জন্য খেলেছেন। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বিদেশের মাটিতেও নিজেদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে তাদের তো আলোকিত করেছেনই, একই সঙ্গে দেশের জন্যও সুনাম কুড়িয়ে এনেছেন। দীর্ঘ প্রায় এক বছর বিরতির পর গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে তিন ম্যাচ সিরিজের একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। স্বভাবতই বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের যে ফর্ম ও দক্ষতা রয়েছে, এতে টিমসহ পুরো দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল ক্রিকেট বিশ্বে তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে আফগানিস্তানকে সহজেই হোয়াইট ওয়াশ করা যাবে। কিন্তু বিধি বাম! প্রথম ম্যাচেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে এক ধরনের ভয় ধরিয়ে দেয় বাংলাদেশ দল। ফলে বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে চলে আসে। সেগুলো হলো, যুদ্ধের ময়দান কিংবা খেলার মাঠে শত্রু বা প্রতিপক্ষকে কখনোই দুর্বল ভাবতে নেই। আফগানিস্তান ক্রিকেট টিমে পাকিস্তানের অনেক ঝানু ক্রিকেটার ওই দেশের হয়ে খেলছেন। কাজেই টিমটি মোটেও তত দুর্বল নয়, যতটুকু ধারণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ দল কর্তৃক দেশের মাটিতে দীর্ঘদিন ধরে সিরিজ কিংবা টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতায় ভাটা পড়েছে। এক বছর আগের ম্যাচগুলোয় ধারাবাহিক বিজয়ে মনের মধ্যে অগাধ আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি ইত্যাদি। এরপরও টাইগাররা সিরিজের প্রথম ম্যাচে প্রাণপণে লড়ে শেষ পর্যন্ত খুব কম ব্যবধানে জিতেছে ঠিকই কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে একটি চাপা ভয়েরÑ যা তাদের পুরো টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে। কারণ এখানে প্রথম ম্যাচে হোয়াইট ওয়াশের স্বপ্নে তো কালিমা লেগেছেই, উপরন্তু সিরিজ জেতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল সন্দেহ ও আশঙ্কা। দ্বিতীয় ম্যাচটিতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হেরে যাওয়ায় ওই নিরাশা বেশি করে দানা বাঁধতে থাকে। তারপর ১ অক্টোবর আসে ওই আশঙ্কাময় দিন। এদিন সিরিজের জয়-পরাজয় নির্ধারিণী খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেদিনের খেলা দেখে মনে হলো টাইগাররা তাদের স্বমূর্তিতে ফিরতে শুরু করেছে। আসলে হলোও তাই। ১৪১ রানের বিশাল ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ২-১ পয়েন্টে জিতে সেখানে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল অভাবনীয় পারফরম্যান্স করতে সমর্থ হয়। এখানে তামিম ইকবাল বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়ে তোলেন। তিনি ম্যাচজুড়ে ধাপিয়ে অনবদ্য ১১টি চার ও দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ১১৮ বলে ১১৮ রান সংগ্রহ করেন। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যানÑ যিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ওয়ান ডে সেঞ্চুরির এ রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। আর টিম হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ছিল এটি দেশের মাটিতে শততম ওয়ান ডে-তে জেতার গৌরব। দলের মনোবল চাঙ্গা করতে ও স্বমূর্তিতে ফেরার জন্য এ সময় বাংলাদেশ দলের ওই টুর্নামেন্টটি জেতার খুব প্রয়োজন ছিল। তা না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট র‌্যাংকিংয়ে এখন বাংলাদেশের যে অবস্থান, তাও একটু কমে যেত। তা ছাড়া এমনিতেই দেশের অভ্যন্তরে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিরাপত্তার অজুহাতে স্থগিত করার প্রক্রিয়ায় ছিল। এরই মধ্যে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার জন্য পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী এসে পৌঁছেছে। আশার কথা, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিম বাংলাদেশের গৃহীত নিরাপত্তাব্যবস্থায় সন্তুষ্ট। এখন বাকিটা নিশ্চয় খেলার পর হিসাব-নিকাশ করা যাবে।

বর্তমানে ক্রিকেটের এটি নতুন বছর হিসেবে নতুন খেলার মাধ্যমে শুভসূচনা হয়েছে। কাজেই সম্প্রতি আরেকটি অন্যধারার সাফল্যের কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে খেলার জন্য বাছাই পর্বে নারী দলের যোগ্যতা অর্জন। ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হন দলনেত্রী কৃষ্ণা রানী সরকারের কিশোরীরা। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে মূল পর্বের ওই প্রতিযোগিতা। তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকবে জাপান, চিন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, লাওসের মতো শক্তিশালী টিম। এ জন্য ওই প্রতিযোগিতার জন্য উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে এসব স্বর্ণ কিশোরীকে কলসিন্দুরের গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এটুকু যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সংবর্ধনার সময় জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে না থাকতেনÑ তাহলে হয়তো এসব স্বর্ণ কিশোরীকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনেই যে এর আয়োজন করতেন, এতে সন্দেহ নেই। ওই সংবর্ধনায় এসব কোমলমতি মেয়ের জন্য ছিল নগদ আর্থিক ও অন্য অনেক প্রণোদনামূলক পুরস্কার ও সম্মাননা। কোনো এক কোম্পানি তাদের জন্য মোবাইল ফোন উপহার দিয়েছে তো, অন্য কোনো কোম্পানি তাদের লেখাপড়ার খরচের দায়দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন আগামী এক বছরের জন্য। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দিয়েছে লেখাপড়ার জন্য হাউস টিউটর সুবিধাÑ যাতে তারা লেখাপড়া চালু রাখতে অসুবিধায় না পড়েন।

যাহোক, একটি বিষয় সবাইকেই খুব আশ্চর্যান্বিত করেছেÑ রাজধানী নয়, মহানগর নয়, জেলা নয়, এমনকি উপজেলাও নয়, সম্পূর্ণ গ্রামপর্যায়ের অখ্যাত একটি স্কুলের একটি নারী ফুটবল দলের বিখ্যাত কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার বিষয়টি ভাবাই যায় না। তারাই আবার কয়েক বছর ধরে স্কুলপর্যায়ে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে দেশব্যাপী ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাপিম্পয়ন হয়ে স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব অর্জন করছেন। অথচ ওই কলসিন্দুরের মাটিতেও তাদের কতই না নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়েছে। ওই স্কুলের নাম কলসিন্দুর। এক সময় বাংলাদেশের ১৭ জেলার একটি ছিল ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহের পিছিয়ে পড়া একটি এলাকার নাম হলো কলসিন্দুর। ওই ময়মনসিংহের ধোবউড়া উপজেলার চারদিকে গারো পাহাড় পরিবেষ্টিত একটি অজপাড়াগ্রামের নাম কলসিন্দুর। কিছুদিন আগে থেকে কলসিন্দুর স্থানটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্রামটি গারো পাহাড়ের পাদদেশে আদিবাসী অধ্যুষিত। সেখানে নেই ঠিকমতো রাস্তাঘাট, যাতায়াতের জন্য কোনো ভালো যানবাহন, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই কারো পারিবারিক সচ্চলতা। এত অভাবের পরও নেই কারো কোনো অভিযোগ। তারা এখন যেমন এলাকার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন, তেমনি আগামীতে যে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করবেনÑ এতে সন্দেহ নেই।

কলসিন্দুর মেয়েদের সাফল্য দিয়েই যাত্রা এবার শুরু হলো। এর একটি প্রভাব আফগানিস্তান-বাংলাদেশে সিরিজে দেখা গেছে। তাদের আলোতেই আলোকিত হোক ইংল্যান্ডের সঙ্গে টুর্নামেন্টসহ সামনের বাংলাদেশের সব খেল।