প্লামি ফ্যাশনস কারখানাও দর্শনীয় যেখানে

সবুজে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর এই স্থাপনাটিই প্লামি ফ্যাশনসের মূল কারখানা ভবনসারিবদ্ধ একেকটি উৎপাদন লাইন। প্রতিটি লাইনের ওপর ঝোলানো নামফলক। কোনোটির নাম মিউনিখ, কোনোটি মিলান, কোনোটি সাংহাই আবার কোনোটি বার্সেলোনা। চিত্রটি নারায়ণগঞ্জের নিট পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্লামি ফ্যাশনসের। পৃথিবীর বিখ্যাত সব শহরের নামে নামকরণ করা হয়েছে উৎপাদন লাইনগুলোর। তা দেখে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।

কৌতূহলী প্রশ্নের জবাবে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানাল, যখনই বিদেশি ক্রেতারা কারখানায় আসেন, তখনই নামকরণ দেখে আবেগাপ্লুত হন। তাঁদের মধ্যে একধরনের ভালো লাগা কাজ করে। পাশাপাশি যেসব শ্রমিক পোশাক তৈরি করেন, তাঁরাও বুঝতে পারেন, যেসব পোশাক তাঁরা বানাচ্ছেন, তা বিশ্বের এসব বিখ্যাত শহরে যায়। তাতে তাঁরাও একধরনের গর্ব বোধ করেন।

কারখানার এক কর্মকর্তা প্রসঙ্গটি আরও একটু ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘যখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকানে গিয়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক দেখি, তখন অন্য রকম এক অনুভূতি তৈরি হয়। সেই অনুভূতির বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরাও আমাদের কারখানায় উৎপাদন লাইনগুলোর নামকরণ করেছি।’

নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে ২১ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক। এটি বিশ্বের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা। কারখানাটি সরেজমিনে দেখলে যে কারোরই দেশের শিল্পকারখানার প্রচলিত ধারণা বদলে যাবে। প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মনের মধ্যে একটু খটকা জাগে, সবুজে ঘেরা সাজানো-গোছানো কোনো বাগানবাড়িতে ঢুকছি ভেবে। বিশাল এলাকাজুড়ে তিনটি ভবন। একটি কারখানা ভবন, একটি অফিস ভবন আর অন্যটিকে শ্রমিক ভবন বলাই শ্রেয়। কারণ, দোতলা ওই ভবনে আছে একসঙ্গে প্রায় ৫০০ শ্রমিকের খাবারের সুবন্দোবস্ত। আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নামাজের ব্যবস্থা ও চারপাশ খোলা প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কারখানার ভেতরের পুরো এলাকায় সবুজের সমারোহ। রয়েছে পুকুর, সেই পুকুরকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে একটি স্থাপনা। এর মাঝখানে দাঁড়ালে মনে হবে পানির খানিকটা নিচে রয়েছি।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, মধ্যাহ্নভোজের এক ঘণ্টার বিরতিতে শ্রমিকদের কেউ কেউ কারখানার সবুজে ঘেরা নানা স্থানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে ছবি তুলছেন। ছবি তোলার মতোই সৌন্দর্যঘেরা জায়গা এটি।

এ ছাড়াও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ভূগর্ভে তৈরি করা হয়েছে একাধিক জলাধার। পুরো ভবনে পাইপ লাগানো আছে, যা দিয়ে বৃষ্টির পানিকে ভূগর্ভের জলাধারে জমা করা হয়। প্লামি ফ্যাশনসের পরিচালক ফয়সাল পরাগ জানান, পুকুর ও ভূগর্ভে নির্মিত জলাধার মিলিয়ে ৮০ লাখ লিটার পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

মূল কারখানা ভবনটি ইস্পাতের (প্রি-ফেব্রিকেটেড) কাঠামোয় তৈরি দুই তলাবিশিষ্ট। তিন পাশেই আছে লম্বা বারান্দা, ওঠানামার পাঁচটি প্রশস্ত সিঁড়ি। পুরো কারখানাটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ভবনের ওপরের তলাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেটি পুরোটাই সূর্যের আলোয় চলবে। নিচতলায়ও স্বচ্ছ কাচের মাধ্যমে সূর্যের আলোর প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসবই করা হয়েছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য।

ভবনটির নকশাবিদ মেহেরুন ফারজানা বলেন, ভবনটি তৈরির ক্ষেত্রে কৃত্রিম আলোর চেয়ে প্রাকৃতিক আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবনটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবনটিতে শ্রমিকদের বের হওয়ার ১১টি পথ রাখা হয়েছে। এরপরও শ্রমিকদের দুর্ঘটনা-ঝুঁকি কমাতে প্রশস্ত বারান্দা রাখা হয়।

ভবিষ্যতে কারখানা সম্প্রসারণের প্রয়োজন হতে পারে। তবু কেন দ্বিতল ভবন—প্রশ্ন করতেই ফজলুল হক জানান, অনেক চিন্তাভাবনা করেই ভবনটির উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনভাবে এটির নকশা করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর দরকার হলেও সেটি সম্ভব না হয়। শ্রমিকের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনটি ভবনের প্রতিটিই এমনভাবে তৈরি, যেখানে বৈদ্যুতিক বাতি না জ্বালিয়ে দিনের আলোতেই কার্যক্রম চালানো সম্ভব। পরিবেশবান্ধব কারখানা হওয়ার শর্ত অনুযায়ী, যেকোনো পরিবেশবান্ধব কারখানায় উন্মুক্ত জায়গা রাখতে হয়। প্লামি ফ্যাশনসের যে জায়গা, তার ৬২ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে বলে জানান কারখানামালিক। এসব উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে হরেক রকম গাছগাছালি ও খোলামেলা জায়গা। সব মিলিয়ে কারখানাটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা।

প্লামি ফ্যাশনসের কর্তৃপক্ষ জানাল, পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) নিয়মকানুন মেনেই কারখানাটি তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়। নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহারেও তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়েছে। নির্মাণ উপকরণের ৯০ শতাংশই দেশীয় সামগ্রী। রয়েছে আধুনিক বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি। তাতেই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবেশবান্ধব বিশ্বের নিট কারখানা হিসেবে ইউএসজিবিসির সর্বোচ্চ ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তা-ও বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট কারখানা হিসেবে। এ ছাড়া চলতি বছর পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের জাতীয় পরিবেশ সনদ।

এ রকম একটি পরিবেশবান্ধব কারখানায় কাজ করে নিজেদের ভালো লাগার কথা জানান শ্রমিকেরা। কারখানার হেলপার নাজমুন নাহার বলেন, ‘এক বছর ধরে কাজ করছি। কারখানার পরিবেশটি খুব ভালো লাগে। বেশ খোলামেলা ও পরিচ্ছন্ন থাকে সব সময়।’

বাইরের প্রকৃতির সবুজের পাশাপাশি সবুজের উপস্থিতি রয়েছে কারখানার অফিস ভবনেও। চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের ডেস্ক—সবখানেই সবুজের ব্যবহার। যদিও সবুজ কার্পেট, সবুজ রঙের চেয়ারগুলো প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম। এই সবুজের সমারোহ দেখে দূর থেকে এটিকে কারখানা না ভেবে কোনো রিসোর্ট ভেবে বসলেও ভুল হবে না।­­­