দারিদ্র্য জয়ের বিশ্বস্বীকৃতি

দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এক অনুকরণীয় নাম—এত দিন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখ থেকে কথাটি শোনা গেলেও এবার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলল বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। সংস্থাটি বলেছে, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে হতদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সংখ্যায় বললে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ অতি দরিদ্র এখন। অথচ ২০০৫ সালে এ হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশি ছিল অতি দরিদ্র। ক্রয়ক্ষমতার (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি-পিপিপি) ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে এখন অতি দরিদ্র তারাই, যাদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের কম। এক ডলার=৭৮ টাকা হিসাবে ১৪৮ টাকার কম আয় করে তারা। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান চিমিয়াও ফান। বিশ্বব্যাংক বলেছে, অতি দরিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের অর্জন অবিস্মরণীয়। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের মতো দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এ খবর এমন এক সময় দেওয়া হলো যখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এ দেশের দারিদ্র্য জয়ের গল্প বিশ্বকে শোনাতে ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ আসছেন।

অবশ্য সরকারের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনের চেয়ে আরো কম। এই হার ১১.২ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম গতকাল সোমবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংক অতি দারিদ্রের হার নিরূপণ করে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি)। সংস্থাটি একজন মানুষের আয় দিয়ে দারিদ্র্য নির্ধারণ করে থাকে। আর সরকার অতি দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করে কস্ট অব বেসিক নিডস (সিবিএন) বা ভোগ পদ্ধতিতে। যেখানে একজনের দৈনন্দিন জীবন ধারণের জন্য যা প্রয়োজন তার ভিত্তিতে। সিবিএন পদ্ধতিতে দেখা যায়, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ১১.২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশের দারিদ্র্যের হার বলতে সে দেশের অতি দারিদ্র্যকে বোঝায়।

গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংক বলেছে, পরিমাপক পদ্ধতিতে তারা কিছু পরিবর্তন আনায় অতি দারিদ্র্যের হার ব্যাপকহারে কমে এসেছে। ২০০৫ সালে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি দৈনিক ১.২৫ ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৮ টাকা) নিচে আয় করলে তাকে অতি দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হতো। সেটিকে সংস্কার করে এখন ১.৯০ ডলার করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নতুন এই মানদণ্ড গত বছর থেকে কার্যকর হলেও বাংলাদেশে হয়েছে এ বছর। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি দৈনিক যদি ১.৯০ ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪৮ টাকা) কম আয় করে, তাহলে সে অতি দরিদ্র হিসেবে গণ্য হবে।

অতি দারিদ্র্যের হার পরিমাপে ১.২৫ থেকে ১.৯০ ডলারে উন্নীত করার ফলে যেখানে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার কথা, সেখানে কমার কারণ কী—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. জাহিদ বলেন, ২০০৫ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারণে ত্রুটি ছিল। তখন টাকার মান কম ধরা হয়েছিল। পাশাপাশি ২০০৫ থেকে ২০১৫ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক শক্তিশালী হয়েছে। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে পদ্ধতিগত সংস্কারের কারণে বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের হার কমেছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৫ সালে দুটি কমলা কিনতে যেখানে ৫২ টাকা খরচ হতো, এখন সেই দুই কমলা কিনতে খরচ হচ্ছে ২৫ টাকা। এতে বোঝা যায়, টাকার মান কতটা শক্তিশালী হয়েছে।

অতি দরিদ্রের হার কমে আসার কারণ জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য। সরকার গত ছয় বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক-নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগণ। এখন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারণে অতি দরিদ্রের হার কমে এসেছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্বব্যাংক পদ্ধতিগত যে পরিবর্তন এনেছে, তাতে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে অতি দরিদ্রের হার কমেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এ হার ছিল ১৩.৮ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১৪.৭। তার আগের বছর ২০১৩ সালে অতি দরিদ্রের হার ছিল ১৫.৫ শতাংশ। এর আগের বছর ছিল ১৬.৪ শতাংশ।

উন্নয়ন আপডেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ১৫ বছর মেয়াদি নতুন যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা (এসডিজি) গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় গৃহীত হয়েছে সেখানে প্রথম লক্ষ্যই হলো দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। শূন্যের কোঠা বলতে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতিটি দেশকে এ সংখ্যা ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন যে হারে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩ শতাংশের নিচে অতি দরিদ্রের হার নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র্য কমে ১.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ যদি প্রতিবছর ৮.৮ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, তাহলে ২০৩০ সালে অতি দরিদ্রের হার ২.৯৬ শতাংশে নেমে আসবে। তবে এই হারে বাংলাদেশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের আপডেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০০৫ সময়ে প্রতি অর্থবছরে গড়ে ৫.১ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ওই ধারায় প্রবৃদ্ধি থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ অতি দরিদ্রের হার কমে ৫.৩৩ শতাংশে নেমে আসবে। আর ২০০৫ থেকে ২০১০—এ সময়ে বাংলাদেশে গড়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ৬.১ শতাংশ হারে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ নাগাদ অতি দরিদ্রের হার কমে আসবে ৫.৯৮ শতাংশে।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ হতে পারে। এর যুক্তি হিসেবে ড. জাহিদ বলেন, দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে ভোগ ব্যয় অনেক কমে গেছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগেও তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও কমে গেছে। এসব কারণে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের এই খরা অব্যাহত থাকলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরো কমে ৬.২ শতাংশে নেমে আসবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশের চলমান বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না, বরং কমছে। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য এটি সুখকর খবর নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে মোট জিডিপির ২১.৮ শতাংশ। আগের বছর যা প্রায় ২৩ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এখানে সঞ্চয়ের অভাব আছে বলে আমাদের মনে হয় না। বিনিয়োগ করার যথেষ্ট সঞ্চয় রয়েছে। তার পরও বিনিয়োগ না হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ থাকলে কোনো বিনিয়োগকারীকে ডাকতে হয় না। সে নিজের স্বার্থেই বিনিয়োগ করতে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আসছে না বলে মত দেন তিনি। বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ বন্ধুসুলভ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে বিদ্যুতের সংযোগ পেতে সময় লাগে ৪০৪ দিন। নির্মাণকাজের অনুমতি পেতে সময় লাগে গড়ে ২৭৮ দিন। নিবন্ধন পেতে লাগে ২৪৪ দিন। আর আইনি কোনো বিষয় নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে এক হাজার ৪৪২ দিন। এসব কারণে বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত হয় না বলে মন্তব্য করেন ড. জাহিদ।

‘বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেটে’ বেশ কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখনো বেশ দুর্বল। এখনো অনেক সংস্থার দরকার। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা এখনো মন্দা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে এ অবস্থা কাটবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন এক মেরুকরণ তৈরি করেছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর হারও কমেছে। খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে। এসব বিষয় বাংলাদেশকে বেশ ভোগাবে বলেও বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাংকের।

অন্যান্য সূচক নিয়ে বিশ্লেষণ : বিশ্বব্যাংক মনে করে, গত অর্থবছর সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ার কারণে তার প্রভাব পড়েছে জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু প্রতি বছর তো আর বেতন-ভাতা বাড়বে না। ফলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভবিষ্যতে। সংস্থাটির মতে, রপ্তানিতে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। যদিও তা শুধু পোশাকখাতভিত্তিক। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ তাঁদের। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গেছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এর কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ও বাড়তি আয় কমে যাওয়া এবং কর্মী ছাঁটাই হওয়া। বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজস্ব আদায়ের হার ভালো নয়। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।