মো. মুস্তাফিজুর রহমান কাজল, জামালপুর: ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম, পাকিস্তান পর্বে গণতন্ত্র, স্বাধিকার এবং মুক্তিযুদ্ধে জামালপুর অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর রয়েছে অসামান্য বীরত্বগাথা। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে জামালপুর অঞ্চলের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে জামালপুরের মেলান্দহে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর নির্মিত হয়।
ব্রিটিশদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে তখন গড়ে উঠেছিল গান্ধী আশ্রম। মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের কাপাশহাটিয়ায় গড়ে তোলা হয় ‘গান্ধী আশ্রম’। তত্কালীন জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক নাসির উদ্দিন সরকার ১৯৩৪ সালে এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন। এই আশ্রমে তিনি গ্রামের মানুষদের স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, লেখাপড়া, চরকায় সুতা তৈরি ও শরীরচর্চা কার্যক্রম চালাতেন।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশপূর্ব ও ব্রিটিশপরবর্তী, পাকিস্তানি শাসনকাল, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা ঘটনাকে তুলে ধরতে এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় এই আশ্রমে এসেছেন শেরেবাংলা
একে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আন্দামান ফেরত কমরেড রবি নিয়োগী, কমরেড মণি সিংহ, বারীণ দত্ত, কমরেড আশুতোষ দত্ত, খোকা রায়, অনীল মুখার্জী, প্রফেসর শান্তিময় রায়, নগেন মোদক, বিধুভূষণ সেন, সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, নরেন নিয়োগী, রণেশ দাশ গুপ্ত, সত্যেন সেন, মন্মথনাথ দে, খন্দকার আবদুল বাকী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কৃষক নেতা হাতেম আলী খান, হেমন্ত ভট্টাচার্যসহ অনেক বিশিষ্টজন। দেশমাতৃকা রক্ষায় এই গুণিজনরা বিভিন্ন সময় এই আশ্রমে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন। আশ্রম এলাকাটি খুবই নির্জন আর প্রত্যন্ত হওয়ায় যেকোনো ধরনের বৈঠক এখানে নিরাপদে সম্পন্ন করা যেত।
পরবর্তী সময়ে দেশভাগের পর মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা ১৯৪৮ সালে এই আশ্রমটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দিন সরকারকে বেধড়ক মারধর করে মৃত ভেবে জঙ্গলের পাশে ফেলে রেখে যায়। এ হামলায় নাসির উদ্দিন সরকারের বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। এর পর থেকে এই আশ্রমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে স্থানীয় এলাকাবাসীর সহায়তায় ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে আশ্রমের সেই পুরনো অফিস ঘরটিকে কেন্দ্র করে পুনরায় গড়ে তোলা হয় গান্ধী আশ্রমটি। এ সময় এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি। বর্তমানে এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগাম জাদুঘরটি নতুন প্রজম্মের শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটিতে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে।
ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে রক্ষিত আছে স্বদেশি আন্দোলন সময়কার আশ্রমে ব্যবহূত চরকা, পুরনো সিন্দুক, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, আশ্রমের সেই সময়কার ছাত্রীদের তৈরি নানা সূচিকর্ম, পাঠাগারের দুর্লভ বই। এ ছাড়াও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটিতে রয়েছে মুক্তি সংগ্রামের নানা স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি, মুক্তিযুদ্ধের নানা তথ্য-উপাত্ত, আলোকচিত্র, দলিলপত্রসহ নানা উপকরণ। এখানে প্রতিদিন নিয়মিত প্রদর্শন করা হয় ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র।
আশ্রমের মূল আদর্শকে ধারণ করে কর্তৃপক্ষ এখানে গ্রামের দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের স্বনির্ভর করতে বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।
এক একর জমির উপর নির্মিত মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটির ভবনের নকশা নির্মাণ করেন স্থপতি মহুয়া নাহাজ খলিল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে। গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক উত্পলকান্তি ধর বলেন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে এই অঞ্চলের বহুমাত্রিক ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যেই গান্ধী আশ্রমের পাশাপাশি এখানে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর নির্মিত করা হয়েছে। এ অঞ্চলের লড়াই-সংগ্রামের স্মারক, তথ্য-উপাত্ত, আলোকচিত্র, দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে এই মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ এক সংগ্রহশালায় পরিণত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর ট্রাস্টি হিল্লোল সরকার বলেন, এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি তরুণ প্রজম্মসহ দেশবাসীকে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের যথার্থ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে। তিনি বলেন, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে আমাদেরকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।