মুহাম্মদ ফারুক খান: বাংলাদেশের আয়তন বাড়ছে। সাগরপ্রান্তে জমি উদ্ধারের ফলে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন নদীর মোহনায় যে চর পড়েছে তা সুপরিকল্পিতভাবে সুরক্ষা ও উদ্ধার করা হলে অন্তত ১৫ হাজার কিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে। যেসব এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে চর জেগে উঠছে সে এলাকায় ক্রসবাঁধ বেঁধে ভূমি উদ্ধার এবং বনায়নের মাধ্যমে তা স্থায়ীকরণ সম্ভব হবে। নেদারল্যান্ডস এ পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ জমি সাগরপ্রান্ত থেকে উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশকেও তারা এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছে।
কক্সবাজার থেকে ৩০ কিলোমিটার সাগরের মধ্যে জেগে উঠেছে খণ্ড খণ্ড চর। সে চরে বেড়ে উঠছে সুন্দরবনের আদলে নতুন বন। বেড়ে উঠছে নতুন পর্যটন এলাকা। নতুন চর জাগছে আর সে চরে হচ্ছে বনায়ন। সাগরে কিছু ভেঙে যাচ্ছে আবার কিছু জমি জেগে উঠছে। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠছে এ প্যারাবন। সুন্দরবনের মতোই এ বনের ভেতরে ছোট ছোট নদী। নদীর দু’পাশে জঙ্গল।
নতুন এ বাংলাদেশ হবে বন্য প্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য। সমুদ্রের মধ্যে ওই এলাকায় প্রতিনিয়ত চরের আয়তন বাড়ছে। নতুন চর জাগছে। যেখানেই চর জাগছে সেখানেই জন্মাচ্ছে নানা গাছ। জেগে উঠছে ম্যানগ্রোভ। কোথাও বন বিভাগের সহায়তায়, কোথাও প্রাকৃতিকভাবে। মহেশখালী, সোনাদিয়া, শাপলাপুর, বড় মহেশখালী, ঘটিভাঙা, বলঘাটা, খোয়ানট এলাকাজুড়ে এই বনভূমি। বনের পূর্ব দিকে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুেকন্দ্র এবং কুহেলিকা নদী। উত্তরে উজানটিয়া নদী। পশ্চিম ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
ভবিষ্যতের অপার সম্ভাবনার এই বন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি দেশের বনজ সম্পদের অন্যতম উত্স হতে চলেছে। সুন্দরবন থেকে যেসব কাঠ শিল্পে জোগান দেওয়া হয়, সেসব কাঠ এখান থেকেও ভবিষ্যতে সংগ্রহ করা যাবে। সুন্দরবন যেমন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে, তেমনই এ বনও দেশের পূর্বাঞ্চলকে ভবিষ্যতে রক্ষা করবে। হতে পারে পুষ্টি উত্পাদক, পানি শুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড়-প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, সম্পদের আধার। এমনকি হতে পারে নতুন পর্যটন কেন্দ্র।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের দিকে বন করার লক্ষ্যে এ অঞ্চলে প্রথম গাছ লাগানো হয়। শুরু হয়েছিল কেওড়া দিয়ে। সমুদ্রের পানিতে লবণ বেড়ে যাওয়ায় এখন কেওড়া গাছ আর বাড়ছে না। বেশি হচ্ছে বাইন। বন বিভাগ কিছু এলাকায় লাগিয়েছে গোলপাতা। গোলপাতা ভালোই বাড়ছে বলে জানান সংশিষ্টরা। এছাড়া আছে ছৈইলা ও ঝাউ। রয়েছে কেয়াকাটা গাছ। মাত্র ৫১ বছরে একেবারে নতুন বনাঞ্চল তৈরি হয়েছে এখানে। বর্তমানে ২৪ হাজার একর জমিতে এই বন আছে। ১৫ বছরে বনের আয়তন হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০০০-০১ সালে এখানে বনের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার একর। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর আগে একটি ছোট্ট চরের আড়াই একর জমিতে চার হাজার ৪৪৪টি গাছ লাগানো হয়েছিল। সেই চরের গাছের বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে এখন হয়েছে প্রায় ২০ হাজার গাছ। নতুন করে ২৭১ একর জমিতে গাছ লাগানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ দুনিয়ার অন্যতম ঘনবসতি দেশ। গত চার দশকে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, শিল্প-কলকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহূত হওয়ায় তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশে এখন চাষযোগ্য জমির অপ্রতুলতা যেমন দেখা দিচ্ছে তেমন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছে না। সাগরপ্রান্তে জমি উদ্ধার করা সম্ভব হলে এ সঙ্কট থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে। সাগরপ্রান্তে নিঝুম দ্বীপের আশপাশের জমি উদ্ধার করে বনায়ন এবং পর্যটন জোন গড়ে তোলা হলে পর্যটন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। উদ্ধারকৃত জমিতে বনায়ন করা হলে ভূমিক্ষয় যেমন রোধ করা সম্ভব হবে, তেমন উপকূলবর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডোর আঘাত থেকে রক্ষা পাবে।
স্বাধীনতার পর নিঝুম দ্বীপে বনায়ন এবং মাত্র কয়েকটি হরিণ ছেড়ে দেওয়া হয়। এ এলাকায় হরিণের সংখ্যা এখন প্রায় ২৫ হাজার এবং বছরে অন্তত ২০ হাজার হরিণ রফতানি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সমৃদ্ধ করা সম্ভব হবে। আরেকটি বিষয় হল, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশের দাবিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকা ও তদূর্ধ্ব মহীসোপান এলাকা এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ হয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত গ্যাস ব্লকগুলোতে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার গ্যাস ব্লকের ১০টি ভারত ও ১৮টি মিয়ানমার দাবি করে আসছিল। এসব ব্লকে বিভিন্ন সময়ে দেশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালাতে গেলেও সম্ভব হয়নি। ভারত ও মিয়ানমারের বাধার কারণে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের সমুদ্র বিষয়ক রায়ে এ বাধার অবসান ঘটেছে। ভারতের সঙ্গে আটটি ও মিয়ানমারের সঙ্গে ১৩টি তেল-গ্যাস ব্লক জিতেছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্জিত সমুদ্রসীমায় আনুমানিক ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) আর ভূসীমায় মজুদ রয়েছে ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে প্রতি বছর দেশে এক টিসিএফ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সে হিসাবে আগামী ১২ বছর পর দেশে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেবে। সমুদ্রসীমায় গ্যাস আবিষ্কৃত হলে এ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে সমুদ্র অর্থনীতির ধারণা বাস্তবায়নে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিমান ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহযোগিতা কাঠামো প্রস্তুতকরণে যৌথভাবে কাজ করছে। প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় সামুদ্রিক মানচিত্র প্রণয়নের পাশাপাশি সম্পদ আহরণ ও সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। একইসঙ্গে কীভাবে সমুদ্র সম্পদ যথাযথ কাজে লাগানো হবে সে বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলে প্রাণিজ সম্পদের পাশাপাশি গ্যাস হাইড্রিড, জিরকন, ইলেমেনাইট, ম্যাগনেটাইটসহ বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগরে নিজ নিজ সীমানায় এ ধরনের খনিজ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এ কারণে ওই দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমুদ্র সম্পদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা নিজ খরচে কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করছে। ভারত তার জাতীয় বাজেটে দুইশ’ কোটিরও বেশি রুপি সমুদ্র সম্পদ আহরণে বরাদ্দ রেখেছে। আর মিয়ানমার চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তার সমুদ্রসীমার মধ্যে থাকা সম্পদ আহরণে কাজ করছে।
শুধুই ভারত আর মিয়ানমারই নয়, আমাদের বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। নতুনভাবে উদ্ধারকৃত সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস ও মত্স্য সম্পদ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে।
পরিশেষে বলছি, বঙ্গোপসাগর দেশের সার্বিক সম্পদের একটি বিশাল উত্স। এই সমুদ্র সীমানার মধ্যে শুধু বিপুল মত্স্য ভাণ্ডার নয়, রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারও। বিশেষ গঠন-প্রকৃতির কারণেই তেল-গ্যাসসহ নানা খনিজ সম্পদ সঞ্চিত রয়েছে এই সাগরের তলদেশে। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশই তাদের টেকসই উন্নয়ন কর্মসূূচির মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশের মতো একটি উপকূলীয় রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সমুদ্র পরিবহন ও বন্দর সহযোগিতা বৃদ্ধি, মত্স্য আহরণ, মত্স্য রফতানি, পর্যটন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ সর্বোপরি জীববিজ্ঞান ও সমুদ্রবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হওয়ার উত্তম সম্ভাবনা রয়েছে। সকল সম্ভাবনাকে সর্বতোভাবে কাজে লাগানোই বর্তমান সরকারের আসল লক্ষ্য।