ভাগ্য বদলে দিল ‘গরুর গাড়ির চাকা’

কাজী আলী আহম্মেদ লিকু, ঝিনাইদহ: গরুর গাড়ির চাকা তৈরির বৃহত্তম জেলা হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে ঝিনাইদহের। দেশের সর্বাধিক চাকা তৈরি হয় এ জেলাতে। অন্যান্য জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা চাকা কিনতে ঝিনাইদহে আসেন। প্রতিদিন বিভিন্ন চাকা উত্পাদনকারী কারখানা থেকে ট্রাকভর্তি করে চাকা নিয়ে যান ক্রেতারা। এই চাকা তৈরির কাজ করেই শতাধিক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। গরুর গাড়ির চাকা তৈরির অন্যতম উপকরণ বাবলা কাঠ। ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জে দেশের সর্বাধিক চাকা তৈরি হয়। এ চাকা যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদর উপজেলার আমতলী বাজার, হাটখোলা মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে, শৈলকুপার ভাটই বাজার, গাড়াগঞ্জ বাজার, খুলুমবাড়ি, কুমিরাদহ ও আবাইপুর বাজারে গড়ে উঠেছে একাধিক চাকা তৈরির কারখানা। তবে দেশের বৃহত্তর চাকা উত্পাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত গাড়াগঞ্জ। বিভিন্ন এলাকার কৃষক ও গৃহস্থরা গরুর গাড়ির চাকার জন্য ছুটে আসেন এসব অঞ্চলে।
সরেজমিনে গাড়াগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান সড়কের দু’ধারে অল্প সামান্য জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে আটটি চাকা তৈরির কারখানা। কারিগরসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি কর্মরত রয়েছেন এখানে। বংশানুক্রমে ব্রিটিশ আমল থেকেই এ পেশাটিকে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব কারিগর এক পর্যায়ে শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ এলাকাসহ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায় এসে কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে চাকা উত্পাদনের বৃহত্তর এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে ঝিনাইদহ।
গাড়াগঞ্জ বাজারের চাকা তৈরির কারিগর আনছার আলী (৭০) জানান, তার বাপ-দাদারাও চাকা তৈরির পেশায় ছিলেন। পিতার কাছেই এ পেশার হাতেখড়ি তার। পিতার সঙ্গে বাড়িতেই চাকা তৈরির করতেন। কিন্তু সেখানে এর চাহিদা কম থাকায় কাজের খোঁজে প্রায় ২০ বছর আগে গাড়াগঞ্জ এলাকায় আসেন তিনি। একটি চাকাতে ১৫শ’ থেকে সাড়ে ১৬শ’ টাকার কাঠ লাগে। আর শ্রমিকের মজুরি ৪শ’ টাকা। বিক্রি করা হয় ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোনো যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি নয়, শুধু হাতুড়ি, বাটাল, করাতের মাধ্যমে তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন এই চাকা। একজন কারিগর একদিনে একটি চাকা তৈরি করতে পারেন।
আরেক কারিগর ফিরোজ হোসেন জানান, বাবলা কাঠই চাকা তৈরির একমাত্র উপাদান। চাকার মাঝের গোল অংশ বেলন, ভেতরের লম্বা লম্বা কাঠ প্যাকো ও চওড়া কাঠের বৃত্তকে কৈঠা বলা হয়।
চাকার মহাজন গোলাম রব্বানী জানান, মাগুরা, আড়পাড়া, বারইচরা, পাবনা, পাংশা, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, যশোর, খুলনা, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরসহ ৩০ জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঝিনাইদহের বিভিন্ন চাকা উত্পাদনকারী কারখানা থেকে ট্রাকভর্তি করে চাকা নিয়ে যান। এভাবেই প্রতিদিন উত্সবমুখর পরিবেশে চাকা ক্রয়-বিক্রয় হয় দেশের প্রধান চাকা উত্পাদনকারী এলাকাটিতে।
চাকা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগররা জানান, অনেক সময় পুঁজির অভাবে বেশি মূল্যে বাকিতে গাছ কিনতে হয়। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতাসহ ব্যাংকঋণের সুবিধা পেলে কৃষি কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এ চাকা শিল্প তথা ঐতিহ্যবাহী গরু মহিষের গাড়ি টিকে থাকবে। সেই সঙ্গে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের ভাগ্যের চাকাও ঘুরবে বলে তারা জানান।