বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম!

প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ : ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তি প্রস্তর, আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট
ইয়াসীন হীরা, চট্টগ্রাম
বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম!চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ভাবনা থেকে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর এ পরিকল্পনার এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। চীনের রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে এটির আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন আগামী ১৪ অক্টোবর। এ জন্য বাংলাদেশে আসছেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং। পদ্মা সেতুর পর কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় দ্বিতীয় ব্যয়বহুল প্রকল্প এটি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের রূপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চীনের সাংহাই নগর দু’ভাগে বিভক্ত। নদীর দু’পাড়ে ইস্ট সাংহাই ও ওয়েস্ট সাংহাই বিদ্যমান। সাংহাইর মতো চট্টগ্রামেও এক নগরে দুটি শহর গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। প্রকল্পটির মাধ্যমে বিদ্যমান চট্টগ্রাম মহানগরীর চেয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে একটি বড় শহর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সম্ভাবনাময় এলাকা যুক্ত হবে মূল শহরের সঙ্গে। এ টানেল দেশের জিডিপিতে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় চট্টগ্রামের সঙ্গে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে টানেল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। যা সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। কর্ণফুলীর তলদেশের এ টানেলটিই হতে যাচ্ছে দেশের একমাত্র সুড়ঙ্গ পথ। মন্ত্রিসভার ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি অনুমোদনসহ প্রকল্পটির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এখন কাজ শুরুর অপেক্ষা। ২০২০ সালের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। টানেলটির মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পানির ১৫০ ফুট নিচ দিয়ে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল নির্মাণ করবে চীন সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের ১৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা করে সিসিসিসি রিপোর্ট প্রদান করে। রিপোর্টে টানেলের বিস্তারিত সুপারিশে বলা হয়, নদীর তলদেশে টানেল হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। পূর্ব প্রান্তের ৪ দশমিক ৯৫২ কিলোমিটার ও পশ্চিম প্রান্তে ৭৪০ মিটার সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক শূন্য ৯২ কিলোমিটার। এছাড়া টোল বুথ ও টোল প্লাজা নির্মাণ করতে হবে ৭২০০ বর্গমিটার। চার লেনের টানেলে উভয় পাশে দুটি টিউব থাকবে। প্রতিটি টিউবের ব্যাস হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার। এর অবস্থান হবে নদীর তলদেশের ১২ থেকে ৩৬ মিটার গভীরে। টানেলের ভেতরে জন চলাচলের সুযোগ থাকবে না। প্রথম পর্যায়ে শহর অংশের কাজ শেষ করে পরে নির্মিত হবে বাকি অংশের কাজ। টানেল ও অ্যাপ্রোচ রোডসহ প্রকল্পটির প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যার মধ্যে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাকি অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার। পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে কর্ণফুলী টানেল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা এবং সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে এ লক্ষ্যে নির্মিত হবে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। কর্ণফুলী টানেলের মাধ্যমে কক্সবাজার, বান্দরবান ও টেকনাফের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নতুন দিগন্ত উšে§াচিত হবে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়ে আনোয়ারায় একটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিমাংশে সাগরের ভেতরের অংশে গড়ে তোলা হচ্ছে বে টার্মিনাল। এ টানেল নির্মিত হলে চাপ কমে আসবে কর্ণফুলী সেতুর ওপর। আউটার রিং রোড, টানেল ও বে টার্মিনাল ঘিরে বাণিজ্যিক যানবাহনগুলো চলাচল করবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেছেন, আগামী ৫/৭ বছরের মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামে এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগের সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। এ বিনিয়োগ এবং ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেছেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে ডিটি রোড থেকে কক্সবাজারমুখী গাড়িগুলো ফৌজদারহাটে আউটার রিং রোড দিয়ে প্রবেশ করে সাগরের পাড় দিয়ে টানেল হয়ে চলে যেতে পারবে। এতে আন্তঃজেলায় চলাচলকারী গাড়ির চাপ থেকে নগরের সড়কগুলো মুক্ত থাকবে।
প্রসঙ্গত, কর্ণফুলীর ওপরে সেতু নির্মাণের সময় ঝুলন্ত ব্রিজ কিংবা টানেল নির্মাণের জন্য ব্যাপক আন্দোলন করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল এই টানেল নির্মাণের। সেই টানেল অবশেষে নির্মিত হচ্ছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর চিটাগাং চেম্বার আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করেছিলেন। আমি তার কথা রেখেছি এবং শিগগিরই টানেল নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’
ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার আলাদা সম্পর্ক রয়েছে। চট্টগ্রাম আমার দ্বিতীয় বাড়ি। চট্টগ্রাম এগিয়ে গেলে আমি খুশি হব।’