প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠ অবদান

রাজনৈতিক পরিবারে রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যেই জন্ম শেখ হাসিনার। সে অর্থে জন্ম থেকেই রাজনীতিতে জড়িত তিনি। পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী, ছাত্রনেত্রী, সব বাদ দিয়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ধরলেও বাংলাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কা-ারির পদে আছেন ৩৫ বছর। আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-নিপীড়ন, হত্যাপ্রচেষ্টাসহ বহু বাধা-বিঘœ পেরিয়ে তিনবার এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন তার দলকে। নিজেও তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী। কেউ যদি শেখ হাসিনার অর্জনগুলো মূল্যায়ন করতে চানÑ এর একটি দীর্ঘ তালিকা প্রণয়ন করা যাবে। সেই দীর্ঘ তালিকার কয়েকটি হলোÑ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ছিটমহল বিনিময় ও স্থলসীমা নির্ধারণ, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় অভূতপূর্ব সাফল্য, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অনেকগুলো মেগা প্রকল্প গ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ফিরিয়ে আনা, জঙ্গিবাদ দমন ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ প্রভৃতি। তবে আমার মতে, গত ৩৫ বছরের শীর্ষপদে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শেখ হাসিনার দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছেÑ ‘রাজনীতির বেসামরিকীকরণ’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেবল জাতির জনককে হত্যা করা হয়নি, গণতন্ত্রকেও বন্দি করা হয় সেনানিবাসে। সেই সময় থেকে পুরো পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে পরিচালিত করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অনধিক একশ অফিসার অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭৩-এর শেষে পাকিস্তান থেকে আগত অফিসারের সংখ্যা ছিল প্রায় এগারশ এবং সাধারণ সৈনিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে ছাড়া প্রায় সবাইকেই সামরিক বাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয় (পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ; মেজর রফিকুল ইসলাম, ২০১১, পৃ. ১১)। শুধু তাই নয়, জনাদশকের মতো বাঙালি অফিসার পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না নিলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর সুপারিশে পুলিশ বাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়। এদের সতীর্থ একজন মির্জা রকিবুল হুদা চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার থাকাকালে ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের জনসভামুখী মিছিলে গুলি করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হিসেবে আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিল। যেখানে ২৬-২৭ জন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী নিহত হন। স্মরণ করা যেতে পারে, এই মির্জা রকিবুল হুদা জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতাসীন হলে পুলিশের উচ্চ পদে আসীন হয়। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর বেসামরিক প্রশাসনে বঙ্গবন্ধু দেশের বৃহত্তম স্বার্থে সবাইকে কাজে লাগানোর নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে যেসব সিএসপি ও ইপিসিএস কর্মকর্তা শেষদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষে চাকরি অব্যাহত রেখেছিল, তাদেরও ক্ষমা করে দেশসেবার সুযোগ দেন। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন এরা এখন বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করবেন। বঙ্গবন্ধুর সরল বিশ্বাস এখানে কাজ করেনি। সেনানিবাস ও সচিবালয় উভয় পাড়াতেই পাকিস্তানপন্থিরা সক্রিয় হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে চরম আঘাত হানার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সর্বশেষ প্রাক্তন সিএসপিটি অবসরে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশবিরোধী যড়ষন্ত্র অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশের প্রথম ত্রিশ বছরে উন্নয়নের ধীরগতির জন্য অনেকেই আমলাদের পাকিস্তানি মানসিকতাকেই দায়ী করেন। আমাদের মাথাপিছু আয় ৫৪০ ডলার পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছিল প্রায় ত্রিশ বছর। ৫৪০ থেকে প্রায় ১৫০০ ডলার তথা তিনগুণ হতে সময় লেগেছে মাত্র দশ বছর। অর্থাৎ সেই সিএসপিরা বলতেন তাদের ছাড়া দেশ চলবে না। অথচ তাদের সবার অবসর গ্রহণের পরই কেবল বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটেছে। দেশি-বিদেশি যৌথ ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রতিনিধি সামরিক চক্র। উল্টোপথে যাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ। স্বৈরশাসকরা দেশে গণতন্ত্র চর্চার সব সম্ভাবনাকেই বন্দি করল সেনানিবাসে নিয়ে। অথচ কুমিল্লা সেনানিবাসে সামরিক একাডেমির প্রথম ব্যাচের সমাপনী অনুষ্ঠানে নতুন অফিসারদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে।… তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী… তোমরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে।’ বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় এটা কখনোই আসেনি এই ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ ফরমেট এমনভাবে সাজানো ছিল যার মধ্যে ‘নামাজ-রোজা-ইসলাম-উর্দু-পাকিস্তানকে’ একাকার করে ভারতবিদ্বেষী একটি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুকরণীয় সেনাবাহিনীর বীজ প্রশিক্ষণের সময়ই ক্যাডেটরা পেয়ে গিয়েছিল তাদের অজান্তেই। সেনাবাহিনীর তখনকার প্রশিক্ষণ মডিউলগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আমাদের বাহিনী’ হওয়ার উপকরণ খুব কমই ছিল। এখন সেনা প্রশিক্ষণের মডিউলে অনেক পরিবর্তন এসেছে, তার পরও আরও অনেক কিছু করণীয় আছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে হবে। সন্দেহ করা হচ্ছে এ জন্য যে, যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি গোলাম আযমের ছেলেরও এ দেশের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদের কাছাকাছি আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আরও কত রাজাকারের সন্তান একই মানসিকতা নিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা উচিত। বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনানিবাসে প্রধানমন্ত্রীর সামনে রাখা কিছু অফিসারের মন্তব্যে এর প্রমাণ আছে। অনেক সময় রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীতমুখী কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত না করে কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় প্রশিক্ষণ একাডেমির দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। অন্তত সিভিল প্রশাসনে এটা প্রায়ই দেখা যায়। একই কাজ যদি সেনাবাহিনীতে হয় তাহলে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকে না। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের পুনঃপাঠ কিছুটা হলেও শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে জিয়ার উত্তরসূরি এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে। এর আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সরকারেই সামরিক শক্তির কর্তৃত্বাধীন ছিল। মন্ত্রিপরিষদের ৪০ শতাংশের ঊর্ধ্বে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি ছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে এ দেশের মানুষ দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ ‘স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার’ প্রয়োগ করতে পারল। কিন্তু শহীদ নূর হোসেনের বুকের লেখা গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পেল না। আংশিকভাবে থেকে গেল সেনানিবাসেই। সেনানিবাসেই থেকে গেলেন গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সামরিক গোয়েন্দাদের খবরদারির পুরোটাই থেকে গেল সরকার ব্যবস্থায়। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও পরে ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এলেও (বিরোধী দলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সেনানিবাসেই থেকে গেলেন) পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক গোয়েন্দারা যে সবকিছুতেই নাক গলাচ্ছিল তার প্রমাণ মেলে ১/১১-এর ষড়যন্ত্রের সময়। প্রকাশ পেতে থাকে আমিন-বারী নামধারী ব্রিগেডিয়ারদের হাতেই বন্দি ছিল এ দেশের গণতন্ত্র। এসব ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সেনানিবাসে জন্মগ্রহণ ও বসবাসকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ২০০৯-পরবর্তী সময়ে দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে দেশে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে আইনসিদ্ধভাবে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসা। এখানেই আমি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এখন সংসদে, রাজপথে বা মিডিয়ায় যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু আজ থেকে ৭-৮ বছর আগেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো অস্থিরতা বা উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হলেই যেমনটি শোনা যেত উত্তরপাড়ার (সেনানিবাসে) খবর কী? এখন আর তেমনটি শোনা যায় না। এক সময় একজন পান বিক্রেতা বা রিকশাঅলাও সেনাবাহিনীর প্রধান, তার পরবর্তী, এর পরবর্তী প্রধানেরও নাম জানত। এমনকি সাভার সেনানিবাসের জিওসি কে? ট্যাংক রেজিমেন্টের দায়িত্বে কে? ইত্যাদি খবরও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে থাকত। এখন সেদিন আর নেই। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সেনানিবাসে অবস্থানকারী একটি দল ও তার নেত্রীকে বের করে নিয়ে আসার কারণেই। অবশ্য সেনানিবাসের স্থায়ী বাসিন্দাদের মনোভাবের পরিবর্তনও এটাকে সম্ভব করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী সত্যিই এখন আমাদের বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতো বারবার নিজের দেশ দখল (ক্ষমতা) করার মানসিকতা আমাদের সেনাবাহিনীতে এখন আর কেউ ভাবে না। আমাদের সেনাবাহিনী এখন সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। গণতন্ত্র চর্চায় আমাদের অনেক সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অভাব, নির্বাচিত পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ ইত্যাদি অনেক সমস্যা আমাদের গণতন্ত্রের আছে। জনসাধারণের মধ্যেও গণতন্ত্রের বিভ্রান্তি রয়েছে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি, যুদ্ধাপরাধী দলের বিচার চাচ্ছি। কিন্তু প্রায় সব শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের তথাকথিত জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। এদের অনেকেই অর্থ, পেশিশক্তি, ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে এবং প্রশাসনিক সহায়তা পেয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি এসব অভিযোগ তুলে যেসব জনগণ ‘নিজামী-মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীকে’ ভোট দিয়েছিল তাদের কী দায়মুক্তি দেওয়া যাবে? এগুলো আমাদের গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করতে হবে। মতপার্থক্য ও সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের গণতান্ত্রিকভাবেই মোকাবিলা করে এগিয়ে নিতে হবে গণতন্ত্রকে। গণতন্ত্রের সঙ্গে উত্তরপাড়ার জড়াজড়ি বা রেষারেষি কোনোটাই কাম্য নয়। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় – See more at: