প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত

একমাত্র শেখের বেটির পক্ষেই সম্ভব, হামাক দশ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে। হামারা এইটা কল্পনাতেও আনবার পারি নাই। দুঃখের দিন শেষ হইয়া গেল বাহে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মাসের গোড়ার দিকে কোরবানির ঈদের ঠিক আগে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে দশ টাকা কেজি মূল্যে পরিবারপ্রতি প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রির সূচনা করার পর এটা ছিল ষাটোর্ধ এক বিধবা মহিলার আনন্দ-অনুভূতি। সরকার দেশের ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে বছরে সাড়ে সাত লাখ টন চাল ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রির যে কার্যক্রম শুরু করেছে, তা ইতোমধ্যে মঙ্গা এলাকা বলে একসময় পরিচিত উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে এভাবেই স্বস্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। দেশের হতদরিদ্র সব মানুষের জন্যই এই কর্মসূচি, বছরে দুবার অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বর তারা এই সুবিধা লাভ করবেন। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ হলো। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ১০ টাকা কেজিতে বছরে দুইবার সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিক্রি করবে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রযাত্রার যে লক্ষ্যমাত্রা তা এই উদ্যোগের মাধ্যমে দ্রুততর হবে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ মার্চ-এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মিলিয়ে মোট পাঁচ মাস ১০ টাকা কেজিতে চাল কেনার সুবিধা পাবে। সরকার ঘোষণা করেছে এই চালপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হবে প্রতিবন্ধী, বিধবা এবং নারীনির্ভর দরিদ্র পরিবারগুলোকে। সরকারের এই কর্মসূচির সাফল্য, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসস্তূপ থেকে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সেই ১৯৭৪ সালে তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে এক চিত্র-সাংবাদিক (বর্তমানে প্রয়াত) এই অঞ্চলের এক বাসন্তী রানীকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সংবাদপত্রে ছাপিয়েছিলেন। মুখে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই দেশের মানুষের এমন একটা চেহারা তুলে ধরাই ছিল ওই অপসাংবাদিকতার লক্ষ্য। যার ইন্ধন জুগিয়েছিলেন এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না। পরে প্রমাণিত হয়েছিল, ছবিটা ছিল পুরোপুরি বানোয়াট। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করে আসছিল। সেই ছবি ছিল তারই অংশ। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকেই কাজের অভাব ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। যার কারণে গোটা এলাকাকে মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল বলা হতো। গত কয়েক বছরে সেই মঙ্গা কথাটি আর শোনা যাচ্ছে না। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে এই অঞ্চলে চালের দাম বাড়ে, সেই সময়টিই সরকার ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণের জন্য বেছে নিয়েছে। ফলে এই জেলাগুলোয় অভাবী পরিবারগুলোতে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। দশ টাকা কেজি দরে মানুষের মাঝে চাল বিক্রির সিদ্ধান্তটি জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। আমরা মঙ্গাকবলিত অঞ্চল হিসেবে যাকে জানতাম, সেই অঞ্চলের মানুষের মাঝে নির্ধারিত মূল্যের এই চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সরকারপ্রধানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
আজ বাংলাদেশ নি¤œ আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে তার যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আমরা নি¤œ আয়ের দেশের তালিকা থেকে নিজেদের বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। এই সক্ষমতা তৈরি হয়েছে দক্ষ নেতৃত্বের কারণে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এখনো দেশের ২৩ শতাংশ মানুষের জীবনের দারিদ্র্য। তাদের জীবন থেকে দারিদ্র্যের এই অভিশাপ দূর করার অংশ হিসেবে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রির সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। কারণ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার নিচে রেখে যে দেশকে কোনোভাবেই মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এই সত্যটিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা উপেক্ষা করেননি। তাই তার মমতাময়ী হাতে তিনি এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচের দিকে বের করে আনতে উদ্যোগী হয়েছেন। সরকারের পরিকল্পনা যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পুরোপুরি মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার স্বপ্ন তা বাস্তবায়নের পথে এই চাল বিক্রির উদ্যোগ শুভ ফল বয়ে আনবে। প্রধানমন্ত্রী তার দূরদর্শী নেতৃত্বগুণের উপলব্ধি থেকেই তাই দারিদ্র্যবান্ধব কার্যক্রমের আওতায় দেশের ৫০ লাখ মানুষকে মাত্র ১০ টাকা কেজিতে চাল কেনার সুযোগ দিয়েছেন। যা বাজারে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। একটি দরিদ্র পরিবারের পক্ষে চাল কেনা বাবদ যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়েই পরিবারটির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। ভাতের অভাব দূর হলেই পরিবারটির পক্ষে অন্যান্য খরচের দিকে নজর দেয়া সম্ভব হবে। তাদের পুষ্টিমানের অভাব দূর হবে। তাদের কাপড়ের সংস্থান হবে। পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে তারা মনোযোগী হতে পারবে। তাই সরকারের এই কর্মসূচি সফল হওয়ার অর্থ হলো দেশের ৫০ লাখ পরিবারের ভাতের অভাব দূর হওয়া। এসব পরিবারের অন্তর্ভুক্ত দুই থেকে তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। যাতে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া অর্থবহ হয়ে উঠবে।
সরকার কম দামে এই চাল পাওয়ার জন্য প্রতিবন্ধী, বিধবা এবং নারীনির্ভর গরিব পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা জানিয়েছে। যথার্থভাবেই সহায়তাগ্রহীতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনকে যথাযথভাবে এই কর্মসূচি সফল করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার যে স্বপ্ন দেখছেন, তার সাফল্য নির্ভর করছে প্রশাসনের যারা এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত, তাদের নিষ্ঠা ও অঙ্গীকারের ওপরে। কারণ নীতি-নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা, বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনের যারা দায়িত্বে থাকেন তারা। জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় রাজনৈতিক নেতাদের। সরকারের এই মহতী কর্মসূচির সফলতার মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভাবী মানুষের মধ্যে দশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে তা যেন কারো অদূরদর্শিতা, কারো অবেহলা, কারো অসতর্কতা, কারো অদক্ষতায় ভেস্তে না যায় সেদিকটিও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নজরদারির যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনিভাবে প্রয়োজন যারা এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন তাদের আন্তরিকতা। সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ এবং দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই জননেত্রী শেখ হাসিনার এই মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে অন্যদের জন্য যা হয়ে উঠবে আর্থিক এবং সামাজিক খাতের রোল মডেল।
লেখক : সাংবাদিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক প্রেস মিনিস্টার