সূর্যাস্তেও কুয়াকাটা, সূর্যোদয়েও কুয়াকাটা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অবলোকন শুধু অপরূপা কুয়াকাটায় সম্ভব। সাগরের ঢেউয়ের শব্দ, জেলের জালে তাজা মাছের লম্ফঝম্ফ—এ ছবি সৈকতজুড়ে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে সোনারচরের হরিণের পাল, আছে শুঁটকিপল্লীর কর্মব্যস্ততা। আকাশের রঙে নীল-লাল হয় সাগরজল। সৈকতের পড়শি রাখাইনপল্লী। রাখাইনদের তৈরি তাঁতকাপড় আর শামুক-ঝিনুকের বাহারি অলংকার চোখ জুড়াবেই। আছে ঐতিহাসিক কুয়া, সেটিও রাখাইনপল্লীতে। পাশেই বৌদ্ধ বিহার। বছরে কার্তিকের পূর্ণিমায় বসে রাস উৎসব। সবই পর্যটক টানার জন্য। এই যে এত সব আয়োজন, তবু কি পর্যটক টানতে পারছে কুয়াকাটা? শুধু পরিকল্পনার অভাবে ভেস্তে যাচ্ছে সব। হোটেল-মোটেল যা-ই আছে, সেখানে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। কুয়াকাটার আশপাশের রূপ ঘুরে দেখতে নেই আধুনিক কোনো যান। রয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব, বেলাভূমির ভাঙন রোধসহ সব কিছুতেই যেন অপূর্ণতা। ফলে যেমনটা টানার কথার ছিল, তেমন পর্যটক টানতে পারছে না কুয়াকাটা। পর্যটকের অভাবে মাঝেমধ্যে শূন্য কুয়াকাটা কাঁদে। সোনারচর : কুয়াকাটাকে ঘিরে সোনারচর। নামই বলে দেয় প্রকৃতি কতটা সৌন্দর্য বিলিয়েছে এখানে। রুপালি বালির ওপর এখানে সারাক্ষণ ছুটছে লাল কাঁকড়া। বিশাল বনাঞ্চলে সুন্দরবনের আমেজ। সোনারচরের অভ্যন্তরে খালের দুই পাশের বন যেন সবুজের নিশ্ছিদ্র দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ছোটাছুটি করছে হরিণের পাল। দেখা মেলে বুনো মহিষ, মেছোবাঘ, বুনো গরু, মোরগ ও শিয়ালের। দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির নিরাপদ বসতি এখানে। শীতে আসে অতিথি পাখি। দিনের আলোয় সোনারচরকে দূর থেকে দেখে মনে হয় কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা নিপুণ ছবি। ক্র্যাবল্যান্ড : শীত শুরু হলেই যোগাযোগের বৈরিতা কেটে যায় ক্র্যাবল্যান্ডের। পর্যটকরা ছুটে আসে কুয়াকাটা থেকে এখানে। প্রকৃতিপ্রেমীরা সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটাতেই এখানে আসে। ঘুরে বেড়ায় ক্র্যাবল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারযোগে এক ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় এখানে। ফাতরারচর : শাল, সেগুন, কেওড়া, গজারি, সুন্দরীসহ নানা বনবৃক্ষ। একই সঙ্গে দেখা মেলে হরিণ, বানরসহ নানা প্রাণীর। গাছ থেকে মধু আহরণ করছে বাওয়ালি। কতই না সৌন্দর্যের খেলা কুয়াকাটা থেকে এক ঘণ্টার দূরে ফাতরারচরে। এ ছাড়া কুয়াকাটাসংলগ্ন তুফানিয়া, চর ফরিদ ও শিবচরের সৌন্দর্য উপভোগ্য। সমস্যার সাতকাহন : সমস্যার গ্যাঁড়াকলে পড়ে সম্ভাবনাময় কুয়াকাটার রূপ-সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আজো নাড়া দিতে পারছে না। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। পদ্মা সেতু এবং পায়রা সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি বিভিন্ন মহলের। বিদেশি কিংবা দেশি অভিজাত পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য পাঁচ কিংবা তিন তারকা হোটেল-মোটেল গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যটন পুলিশ কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও রয়েছে জনবল সংকট। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কুয়াকাটায় আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র এবং বেলাভূমির ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফায় আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কুয়াকাটার সৌন্দর্য বাড়ানো ও ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিলেও তা টেবিলে টেবিলে ঘুরছে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ অর্থবছরে কুয়াকাটায় একটি উদ্যান গড়ে তোলে বন বিভাগ। কিন্তু সাগরের অব্যাহত ভাঙনে তা এখন বিলীনপ্রায়। তবে বর্তমানে পর্যটন সম্ভাবনা বিবেচনায় কুয়াকাটা সৈকতের পূর্ব প্রান্ত গঙ্গামতি থকে শুরু করে পশ্চিম প্রান্ত লেম্বুর বন পর্যন্ত এলাকা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের ন্যাশনাল পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ওই প্রকল্প এখনো দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। এ ছাড়া কুয়াকাটার সঙ্গে সারা বিশ্বের যোগাযোগ সহজতর করতে পটুয়াখালী বিমানবন্দর পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে সম্প্রসারণ কাজ চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওই বিমানবন্দর সক্রিয় হলে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে দূরত্ব ঘুচবে দেশ-বিদেশের। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল সমিতির সম্পাদক মো. মোতালেব শরীফ জানান, সন্ধ্যা হলে গোটা সৈকত অন্ধকার হয়ে যায়। নিরাপত্তায় ভোগে পর্যটকরা। কুয়াকাটার মূল পয়েন্টসহ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে প্রায় এক কিলোমিটার বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ছাড়া এমিউজমেন্ট পার্ক, সিনেপ্লেক্স ও কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন জরুরি। কুয়াকাটার পৌর মেয়র আব্দুল বারেক মোল্লা জানান, আধুনিক পর্যটনকেন্দ্রের কোনো সুবিধা নেই এখানে। একটি পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি। পর্যটন শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলা হলে পাল্টে যাবে কুয়াকাটা। আর্থসামাজিক অবস্থার পরির্বতন ঘটবে এ অঞ্চলজুড়ে। আসবে বৈদেশিক মুদ্রাও। জেলা প্রশাসক এ কে এম শামীমুল হক সিদ্দিকী জানান, সৈকতের ভাঙনরোধে ইতিমধ্যে পাউবো একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পর্যটন উন্নয়ন করপোরেশন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০০ একর জমির ওপর একটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বাস্তবায়িত হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পাশাপাশি সোনারচর, ক্র্যাবল্যাল্ড ও ফাতরারচর আরো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।