বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতে ডিজিটাল কাজের প্রসারের সম্ভাবনায় ‘রোমাঞ্চিত’। তবে তারা ২০২০ সালের কর্মক্ষেত্রে মানবীয় দক্ষতাই অগ্রাধিকার পাবে বলে মনে করে। এ ছাড়া এ দেশের শতভাগ তরুণের ধারণা, ভবিষ্যতে অনেক পেশায় মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে রোবট। গতকাল রবিবার প্রকাশিত টেলিনর গ্রুপের একটি পরীক্ষামূলক অনলাইন জরিপের ফলাফলে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার ছয়টি দেশে অনলাইন জরিপটি পরিচালিত হয়। এ সহস্রাব্দের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা, প্রযুক্তির প্রভাব এবং ভবিষ্যতে চাকরির জন্য নিজেদের সর্বোত্তম উপায়ে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা বিষয়ে জরিপটি পরিচালিত হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তরুণরা তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছে। যদিও তারা বিশ্বাস করে, সফল ক্যারিয়ার গঠনে কারিগরি ও মানবীয় দক্ষতা দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া জরিপের ফলাফলে জানা গেছে, উত্তরদাতাদের শতভাগের ধারণা, ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে রোবট একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী চার হাজার ২০০ তরুণ ‘জবস ফর ফিউচার’ শীর্ষক এ অনলাইন জরিপে অংশ নেয়। জরিপটি টেলিনর গ্রুপের ফেসবুক পেজের ব্যবহারকারীদের টার্গেট ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। প্রতিটি দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নমুনার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে টেলিনর গ্রুপের সোশ্যাল মিডিয়া ডিরেক্টর শীনা লিম বলেন, ‘আমাদের ফেসবুক চ্যানেল এশিয়ার তরুণদের একটি বড় অংশের কাছে পৌঁছে গেছে। তাই এ রকম একটি জায়গাকেই আমরা পরীক্ষামূলক এ জরিপ চালানোর জন্য উপযুক্ত মনে করেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ভেবে দেখেছি সামাজিক মাধ্যমে প্রযুক্তি ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে এশিয়ার তরুণদের ভাবনা ও সম্ভাব্য মনোভাব সম্পর্কে জানার জন্য ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে।’ বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনের চাবিকাঠি ডিজিটাল প্রযুক্তি : বাংলাদেশে তরুণদের ৬০ শতাংশ জানিয়েছে, তারা ইন্টারনেট ও ডিজিটাল খাতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে ‘রোমাঞ্চিত’। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ জানিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে ‘অত্যন্ত রোমাঞ্চিত’। এ ছাড়া ২০২০ সালের মধ্যে ইন্টারনেট বা মোবাইল প্রযুক্তি তাদের ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছে ৫৯ শতাংশ। ছয়টি দেশের ৬৩ শতাংশ তরুণ সমষ্টিগতভাবে এ ব্যাপারে একমত হয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র ১.৪ শতাংশ তরুণ জানিয়েছে, তাদের ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ‘খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়’। মানবীয় দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন : জরিপকৃত তরুণদের মধ্যে একটি দেশ ছাড়া বাকি সবাই একমত, ভবিষ্যতে চাকরির জন্য অ-কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোচ্চ পরিমাণ বাংলাদেশি (৩৪ শতাংশ), পাকিস্তানি (৩৭ শতাংশ) এবং ভারতীয় (৩৬ শতাংশ) তরুণ মনে করে, ভবিষ্যতে চাকরির সুযোগের জন্য ‘অন্যদের অনুপ্রেরণাদানের ক্ষমতা’ এবং ‘নেতৃত্বদানের দক্ষতা’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিঙ্গাপুরে জরিপকৃত প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বেশি তরুণ মনে করে, ‘মানব ব্যবস্থাপনা ও আবেগজনিত বুদ্ধিবৃত্তি’ (২৯ শতাংশ) গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে তিনজনের একজন তরুণ ‘ক্রিয়েটিভ, কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির’ দক্ষতাকে চিহ্নিত করেছে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার তরুণরা একটু ভিন্ন। তাদের ২৪ শতাংশ জানিয়েছে, প্রযুক্তিবিষয়ক ‘মোবাইল ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং সুপার কোডিং দক্ষতা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের তরুণরা (৯ শতাংশ) জরিপে জানিয়েছে, ভবিষ্যতে চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডাটা অ্যানালিসিস এবং রিসার্চ ও ইন্টারপ্রিটেশন। মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে রোবট : অন্যান্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের শতভাগ তরুণই একমত হয়েছে যে সামনের দিনগুলোতে অনেক পেশার ক্ষেত্রেই মানুষের জায়গা দখল করে নেবে রোবট। কোন পেশার ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটবে এমন প্রশ্নের ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশি উত্তরদাতা অনুমানের ভিত্তিতে জানিয়েছে যে উৎপাদন ও প্রকৌশল শিল্প খাতে যন্ত্র মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরো ২১ শতাংশ তরুণ জানিয়েছে, রোবটের মানুষের জায়গা নেওয়াটা তাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। জরিপকৃত অন্যান্য দেশের তরুণরাও জানিয়েছে, উৎপাদন ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে রোবট মানুষের জায়গা করে নেবে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার ৪৪ শতাংশ, মিয়ানমারের ৪১ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ও ভারতের ৩৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৩৪ শতাংশ তরুণ এ ব্যাপারে ইতিবাচক মতামত দিয়েছে। এশিয়ার তরুণরা কোন কোন গুণাবলি নিয়ে চাকরির বাজারে আসবে : তরুণ চিন্তাবিদ ও শিক্ষার্থী হিসেবে তরুণদের তাদের যোগ্যতার কথা জিজ্ঞেস করা হলে বেশির ভাগ বাংলাদেশি (২৬ শতাংশ), সিঙ্গাপুরের (৩২ শতাংশ) এবং মালয়েশিয়ার (২৪ শতাংশ) তরুণ জানিয়েছে, তাদের ‘ন্যায়বিচারের প্রতি সহানুভূতিশীল ও তাদের সুরক্ষার’ সদিচ্ছা রয়েছে। পাকিস্তানের তরুণদের (২৪ শতাংশ) একটি বড় অংশ জানিয়েছে, তাদের ‘কৌশলগত দূরদৃষ্টি ও বৃহৎ পরিসরে ভাবার’ দক্ষতা রয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের (৩০ শতাংশ) ও ভারতের (২৪ শতাংশ) তরুণ জানিয়েছে, তাদের ‘সৃষ্টিশীল ও তাদের স্বভাবতই চিন্তা করার’ দক্ষতা রয়েছে। অথচ বাংলাদেশি উত্তরদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে কম (১৪ শতাংশ) জানিয়েছে, তাদের ‘গণিতে দক্ষতা এবং অত্যাধুনিক বিশ্লেষণী’ দক্ষতা রয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের ১৩ শতাংশ ও ভারতের ১৪ শতাংশ তরুণ মনে করে, তাদের এ দক্ষতা রয়েছে। প্রযুক্তি ও মানব সংযোগে আগ্রহ : বাংলাদেশের তরুণরা প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহী। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং ভারতের তরুণরা ‘সব ধরনের প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ, যত দূর সম্ভব আমি জানতে চাই’—এ ব্যাপারে একমত। মিয়ানমারের তরুণরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। মিয়ানমারের ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের ৩১ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ার ২৮ শতাংশ তরুণ জানিয়েছে, ইন্টারনেটের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, ইন্টারনেট ‘সব ধরনের মানুষ ও ধারণার সঙ্গে যুক্ত করিয়ে দেয়।’ টেলিনর গ্রুপের পিপলস ডেভেলপমেন্টের হেড অব ডিজিটাল ক্যাপাবিলিটিস ইয়াসু সাতো বলেন, “তরুণরা শুধু প্রযুক্তি ও সুযোগের প্রতি শ্রদ্ধাশীলই নয়, এ ছাড়া তারা নিজেদের সহানুভূতিশীল ও সৃষ্টিশীল মনে করে। প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট তরুণদের ক্যারিয়ারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে তারা এটি নিয়ে রোমাঞ্চিত। প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে তারা সবাই একমত। এটি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। এ জরিপের ফলাফলে ‘এশিয়া হচ্ছে মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের জায়গা, এসব তরুণ তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে অর্থবহ অবদান রাখতে চায়।’”