আমড়া যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে

ঝালকাঠি জেলার চার উপজেলার ২৮৮ গ্রাম এবং দুইটি পৌরসভার ১৮ ওয়ার্ডের ৬৫০ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ প্রতিটি বাড়িতে আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। ঝালকাঠির আমড়ার সুনাম-সুখ্যাতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে রাজাপুরের আমড়ার সুনাম আরও বেশি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে এ অঞ্চলের আমড়ার চাহিদা ব্যাপক। বর্তমানে আমড়া চাষে এ অঞ্চলের মানুষ অনেক বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছে। কৃষি অধিদফতর সূত্র জানায়, জেলার ২৮৮টি গ্রামের ৫৫০ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর আমড়ার আবাদ করা হয়। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৯০টি গ্রামের ১৯৫ হেক্টর, নলছিটির ৯০টি গ্রামের ৩০ হেক্টর, রাজাপুরের ৫৪টি গ্রামের ২৫৫ হেক্টর এবং কাঁঠালিয়ায় ৫৪টি গ্রামের ৭০ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর আমড়ার চাষ করা হয়। এছাড়া পৌরসভার ১০ হেক্টর জমিতেও আমড়া চাষ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আমড়ার চাষ হয় রাজাপুরে এবং কম চাষ হয় নলছিটিতে। কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মোঃ শাহজালাল জানান, আমড়া চাষের জন্য এ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু বেশ উপযোগী।
স্থানীয়রা বলছেন, এবার ‘আমড়া বন্ধনে’ হারিয়ে যাওয়ার গল্প। স্বপ্ন দেখছেন বিশ্ব ছোঁয়ার। এ সম্ভাবনাও নেহায়েত কম নয়। ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলীর আমড়া চাষি রিপন চৌধুরী। তার পাশে নৌকা নিয়ে ভাসছিলেন মলয় হালদার। এসব বিষয়ে তিন নৌকার পাটাতনে বসে বিস্তর কথা হয়। পেয়ারার রাজ্যে তারা আমড়া বিপ্লবের কথা শোনান। রিপন চৌধুরী ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়েছেন এ বছর। আষাঢ়ের শুরুতে যখন ফল ধরার আগ মুহূর্তে জমির একাংশ নেন ২৫ হাজার টাকায়। কেমন লাভ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জমিতে ৫০ মণের ওপরে আমড়া ধরবে। এরই মধ্যে ১০ থেকে ১৫ মণ বিক্রি করা হয়েছে। রিপন জানান, তৃণমূলে অর্থাৎ বাগান থেকে সংগ্রহ করা আমড়া প্রথম দিকে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এখন তা সাড়ে ৪০০ থেকে ৮০০’র কাছাকাছি। আমড়া পেয়ারার মতো অতিদ্রুত পচনশীল নয়। নৌকা বেয়ে ভীমরুলী ভাসমান হাটে যাচ্ছিলেন মলয় হালদার। দু’পক্ষের কথা শুনে থমকে দাঁড়ান তিনি। পেয়ারা শেষ, নৌকায় কেবল আমড়া আর আমড়া। হাটের খানিক আগে, একটু বাঁয়েই তার বাগান। মনোরম সুন্দর পরিবেশ আর পাখির কলকলানির মধ্যে সাত সকালে আমড়াগুলো পাড়া হয়েছে বলে জানান মলয়। বিক্রি করবেন হাটে, তা চলে যাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। তিনি জানান, গুণ-মান ভালো দেখেই এখানকার আমড়ার চাহিদা আছে। যারা আমড়া কেনেন সবাই চান এ অঞ্চলেরই কিনতে। এদিকে, ভীমরুলীতে বাগান পরিদর্শনে উঠে এলো চাষিদের কিছু সমস্যার কথাও। বর্ষা মৌসুমে এক ধরনের লেদা পোকা গাছের পাতা খেয়ে, পাতাশূন্য করে ফেলে। এতে আমড়া চাষে ক্ষতি হয়। এজন্য কৃষক-চাষি-বাগানিরা চান স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তা। কিন্তু সাড়া পান না তেমন। তারা কীটনাশকমুক্ত আমড়া চাষাবাদে আগ্রহী। ভীমরুলীতে আড়ত ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি। চলে আমড়া বিকিকিনির হাঁকডাক। ডুমুরিয়া, বেতলা, ডালুহারসহ ঝালকাঠির বেশির ভাগ গ্রাম পেয়ারার পাশাপাশি আমড়া চাষের জন্যও বিখ্যাত। বর্তমানে এসব আমড়া বিক্রি হচ্ছে আটঘর, পিরোজপুরের কুরিয়ানাসহ ঝালকাঠির ভীমরুলী পানিতে ভাসমান বাজারে। তবে সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার ভীমরুলী। সকাল ৮টার মধ্যে বাজার বসে, বেচাকেনা চলে দুপুর পর্যন্ত। এছাড়া ঝালকাঠি হয়ে জলপথে কিংবা সড়ক পথে সোজা বরিশাল অথবা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি দিয়ে গরিয়ারপাড় থেকে বরিশাল সদরে প্রবেশ করছে এসব অঞ্চলের সুস্বাদু ফল আমড়া। এদিকে বরিশালের সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, কাউখালী এবং ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর ও নলছিটিতে আমড়ার আবাদ হয়েছে বাম্পার। এসব অঞ্চলের দেড় হাজার একরেরও বেশি জমিতে সরাসরি আমড়া চাষ হচ্ছে। স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানাতেও আমড়া বিক্রির জন্য রয়েছে ভাসমান হাট। ছোট ডিঙিতে বা নৌকায় করে চাষি-বাগানিরা আসেন এখানে। আর ট্রলারে করে আড়তদাররা তা কিনে নেন। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার খেয়াঘাট পেরিয়ে মাহমুদকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর, ধলহার, ব্রাহ্মণকাঠি, আদমকাঠি এরপর পাশের জেলা ঝালকাঠি। তার দুই-এক কিলোমিটার পরেই ভীমরুলীতে প্রবেশ। এসবই ভাসমান হাট। আশ্বিনজুড়েই আমড়া বিক্রিতে এসব হাট জমজমাট থাকবে। ভীমরুলীর আড়তদার লিটন হালদার জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মণ আমড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর পাঠানো হচ্ছে। বস্তা হিসেবে আমড়া যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। আড়াই মণের বস্তার দাম ৭০০ থেকে ৮০০’র মধ্যে। আশ্বিনের শেষভাগে যখন আমড়া শেষের দিকে থাকবে তখন এ দাম আরও বাড়বে। এছাড়া লন্ডনেও গত বছর থেকে এ অঞ্চলের আমড়া রফতানি হচ্ছে।