এত দিন এই খুপরিতেই বাস করছিলেন পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার চরখালী গ্রামের মহেন্দ্র হালদার। তাঁর এই অসহায় জীবন পাল্টে দিতে এগিয়ে এলেন চার বন্ধু। তুলে দিলেন নতুন ঘর (ইনসেটে)। ছবি : কালের কণ্ঠ
অ- অ অ+
দরজা-জানালাহীন খুপরিতে বসতি। সেই খুপরিতে সোঁদা মাটির বিছানা। ঝড়-বৃষ্টি, বৈরী বাতাস আর বিষধর প্রাণীর সঙ্গে লড়াকু জীবন। অসহায়ত্বের এ জীবনের নাম ‘মহেন্দ্র হালদার’। জ্বীর্ণ-শীর্ণ একাকী মানুষ। সত্তরোর্ধ্ব গৃহহীন এই মানুষের দেখার কেউ নেই। তবু ভিক্ষায় বাঁচেন না মহেন্দ্র। অসহায় এই একাকী জীবনে নিজেই রান্না করেন। কখনো এক বেলা, আবার কখনো চলে অনাহার।
নিজে ভাগ্যহীন হলেও একসময় গণনা করতেন মানুষের ভাগ্য। শিশুদের পড়াতেন। এ জন্য এলাকার মানুষ তাঁকে ডাকত ‘মহেন্দ্র মাস্টার’। নিজের তিন কাঠা জমির ভিটা আছে। তবু ওই ভিটাতে তাঁর একটা ঘর ছিল না। মহেন্দ্র নিজের ভিটাতে একটি ঘরের স্বপ্ন দেখতেন। জীবনের ক্রান্তিকালে এসে সেই ঘরে তাঁর ঠাঁই হবে। একটি খাট, একটি মশারি, একটি টেবিল, পাকা ল্যাট্রিন আর নিজের দরকারি জিনিসপত্র সাজানো থাকবে সেই ঘরে। বাড়ির স্বপ্নটা পূরণ হলে আর খুপরিতে বৃষ্টি-ঝড়ে জবুথবু হয়ে থাকতে হবে না তাঁর। স্বপ্নটা অবশেষে ধরা দিল। এলো মহেন্দ্রর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার চরখালী গ্রামের মহেন্দ্র হালদার গতকাল বুধবার স্বপ্নের বাড়ির চাবি হাতে পেয়েছেন। মাটিতে ঘুমানো মহেন্দ্রর এখন নতুন চকচকে টিনের একটি প্রশস্ত বাড়ি হয়েছে। পাকা ল্যাট্রিন। শোবার ঘরে নতুন খাট, বিছানা, বালিশ আর নতুন চাদর ও মশারি। সেই সঙ্গে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আসমানী’।
বুধবারের সকালটা তাই দুর্ভাগা মহেন্দ্রর স্বপ্নপূরণের দিন। মহেন্দ্রর স্বপ্নের বাড়ির আঙিনাজুড়ে শত লোকের আনাগোনা। নতুন ঘরে ওঠার ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী নতুন ঘরে সকালে নারায়ণ পূজা আর সন্ধ্যারাতের কীর্তনের আয়োজন করেছেন তিনি। এ জন্য তিনি গ্রামের শতাধিক মেহমানের জন্য রাতে ডাল-ভাতের আয়োজনও করেন।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের গ্রাম চরখালী। নিভৃত গ্রামে একচিলতে পাকা রাস্তা চলে গেছে বৃদ্ধ মহেন্দ্রর বাড়ির দিকে। এই গ্রামের প্রয়াত বসন্ত হালদার ও মালতী রানী দম্পতির বড় ছেলে মহেন্দ্র হালদার। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। এরপর পরের জমিতে কামলা খেটে জীবন ও জীবিকা চলছিল। মহেন্দ্রর ছোট ভাই জিতেন্দ্র হালদার পাঁচ বছর আগে মারা গেলে মহেন্দ্র বিপাকে পড়ে যান। স্ত্রী-সন্তান কেউ নেই তাঁর। অসহায় মহেন্দ্র জমি-জিরাত বলতে তিন কাঠার এক টুকরো ভিটে। সেখানে খুপরি তুলে চলছিল মহেন্দ্রর জীবন লড়াই। ২০ বছর আগে মহেন্দ্রকে এলাকার এক দুর্বৃৃত্ত লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করলে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে যায়। সেই থেকে তাঁর কুঁজো হয়ে বেঁচে থাকা।
মহেন্দ্রর এই স্বপ্নপূরণের সারথি চার বন্ধু। তাঁরা হলেন উন্নয়নকর্মী সাহিদুর রহমান, আইসিডিডিআরবির গবেষক বীথি বিশ্বাস, সুনামগঞ্জের একটি ক্লিনিকের চিকিৎসা কর্মকর্তা মিশাল পাল ও রাজধানীর মেডিনোভার চিকিৎসা কর্মকর্তা দীপা বড়ুয়া। প্রথমে চার বন্ধু মিলে ঘরহীন নিঃসঙ্গ মহেন্দ্রর স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পরে ময়মনসিংহের উন্নয়ন সংগঠন ‘আসমানী’ এ উদ্যোগে যুক্ত হয়। ২৫ দিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় স্বপ্ন বাড়ি।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী সাহিদুর রহমান আন্তর্জাতিক সার উন্নয়নকেন্দ্রের (আইএফডিসি-ইউএসএইড) একটি প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা। তাঁকে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া কর্ম এলাকায় যেতে চরখালী-ভাণ্ডারিয়া সড়ক পার হতে হয়। সাহিদুর প্রায় সড়কে কুঁজো হয়ে এক বৃদ্ধকে হেঁটে যেতে দেখতেন। সাহিদুরের বৃদ্ধের প্রতি কেন যেন কৌতূহল জাগে।
সাহিদুর জানান, তিনি তাঁর বসতি দেখে অবাক হয়ে যান। বসতঘর নয় যেন একটা লতাপাতার বাগান। সেখানে ডালপালা আর শত ছিন্ন মলিন কাপড় ছাওয়া খুপরিঘর। যেন আদিম বসতি। একাকী এই মানুষের দুরবস্থা দেখে সাহিদুর মনস্থির করেন বৃদ্ধের এই আদিম বসতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বৃদ্ধের ওই খুপরিঘরের ছবি তুলে গত ২৫ জুলাই নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি মানবিক স্টেটাস দেন। সেখানে তাঁর বন্ধুদের সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানান। এভাবেই শুরু হয়ে যায় স্বপ্ন ঘর নির্মাণ প্রকল্প। সমমনা মানবিক মানুষের সহায়তা মিলে যায় দ্রুত। গত ২৫ আগস্ট বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয়। উদ্যোক্তা সাহিদুর রহমান ও সহকর্মী মঠবাড়িয়ার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার কর্মকার মিলে এ কাজের তদারকি করেন। তাঁরা বলেন, মহেন্দ্র হালদার হচ্ছেন পল্লীকবির এ যুগের ‘আসমানী’। তাই তাঁর ঘরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আসমানী’।
খুপরি ছেড়ে নতুন ঘরে উঠতে পেরে মহেন্দ্র হতবাক। আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না। ছলছল চোখে যেন তিনি বাকরুদ্ধ। কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি একটা ঘরের স্বপ্ন দেখেছি। ভেবেছি, স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাবে। ভেবেছি, এই খুপরিতেই একদিন মরে পড়ে থাকতে হবে। যারা স্বপ্ন পূরণ করে দিল তাদের আমার দেওয়ার কিছু নাই। শুধু বলি, মানুষগুলো যেন ভালো থাকে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘মহেন্দ্র কাকু অসহায়, সেটা জানি। তাঁর জন্য একটি ঘর নির্মাণ হয়েছে শুনেছি। তাঁর বয়স্ক ভাতার কার্ড যাতে হয় সে উদ্যোগ নেব।’
এ ব্যাপারে ভাণ্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আতিকুল ইসলাম উজ্জল বলেন, ‘ঘরহীন অসহায় বৃদ্ধের জন্য ঘর তুলে দেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব। মহেন্দ্রর জন্য কয়েকজন তরুণ ঘর নির্মাণ করেছেন, বিষয়টি এ মুহূর্তে আমার জানা ছিল না। তবে এমন উদ্যোগ মহতী ও প্রশংসনীয়। বৃদ্ধের খোঁজ নিয়ে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’