বিমানবন্দর ঘিরে মহাপরিকল্পনা

সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প * দুই লাখ ৩ হাজার বর্গমিটার জমিতে থার্ড টার্মিনাল * ১২ হাজার ফুট দৈর্ঘ্যরে দ্বিতীয় রানওয়ে * ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী
দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালের উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই দৃশ্যমান হবে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বছরে দুই কোটি যাত্রী ধারণ করতে পারবে শাহজালাল। বিশ্বের সুপরিসর উড়োজাহাজ এখানে ওঠানামা করতে পারবে। এছাড়া বিমানবন্দরটি হবে দেশের অন্যতম নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তি। ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে। ইতিমধ্যে এর চূড়ান্ত নকশাও অনুমোদন করেছে জাইকা।

জানা গেছে, প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৩ হাজার ৭শ’ কোটি টাকায় থার্ড টার্মিনাল, ২ হাজার ৩শ’ কোটিতে দ্বিতীয় রানওয়ে এবং ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ১০০ কোটি টাকার সিকিউরিটি এনহান্সমেন্ট, ১৫ কোটি টাকার ফ্লাইট ক্যালিব্রেশনসহ অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল, ভিভিআইপি কমপ্লেক্স, কার্গো কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে। বিমানবন্দরের সামনে যাতায়াতের জন্য নির্মাণাধীন উড়াল সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত র‌্যাপিড বাস ট্রানজিট পয়েন্টের সঙ্গে হবে থার্ড টার্মিনালের স্বতন্ত্র সংযোগ। এতে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণসহ দেশের সব প্রান্ত থাকেই আসা যাত্রীরা গোলচক্কর থেকে স্বতন্ত্র সংযোগ দিয়েই অনায়াসে থার্ড টার্মিনালে যেতে পারবে।

সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি যুগান্তরকে বলেন, জাপানের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনাল এবং দ্বিতীয় রানওয়ে নির্মাণের সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আগামী বছরের মধ্যে শাহজালালে আন্তর্জাতিক মানের ও দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় টার্মিনালের কাজ দৃশ্যমান হবে। আগামী বছরের প্রথম দিকেই কাজ শুরু হবে। শেষ হবে ২০২০ সালে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কার্গো ভিলেজ আধুনিকায়নের কাজ শেষ হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার জমির ওপর নির্মিত হবে শাহজালালের থার্ড টার্মিনাল। যার ধারণ ক্ষমতা হবে বছরে কমপক্ষে দুই কোটি যাত্রী। তৃতীয় টার্মিনালের জন্য ১২ হাজার ফুট দীর্ঘ নতুন রানওয়ে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বর্তমান রানওয়ের দৈর্ঘ্য আরও দেড় হাজার ফুট বৃদ্ধি করে ১২ হাজার ফুটে উন্নীত করা হবে। সেক্ষেত্রে শাহজালালে দুটি রানওয়ে থাকবে। এতে বিশ্বের সুপরিসর উড়োজাহাজ ওঠানামা করতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। এই বিমানবন্দর দিয়ে আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে।

থার্ড টার্মিনালের নকশায় ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ ও ১৩টি আগমনী বেল্ট আছে। থাকবে পর্যাপ্তসংখ্যক একসেলেটর, সাবস্টেশন ও লিফট। এছাড়া থাকবে রাডার, কন্ট্রোল টাওয়ার, অপারেশন ভবন, বহুতল কারপার্ক। তিনতলাবিশিষ্ট এই টার্মিনাল ভবনটির স্থাপত্যরীতিতে আনা হবে অনন্য নান্দনিকতা। এর বহির্দৃশ্য ও ভেতরের গঠন প্রকৃতিতে থাকবে অপূর্ব ও মন জুড়ানো সব স্থাপনা। প্রসঙ্গত বর্তমানে শাহজালালের মূল টার্মিনালে আছে মাত্র আটটি বোর্ডিং ব্রিজ।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, থার্ড টার্মিনালের মূল নকশা, গঠন প্রকৃতি, আকৃতি ইতিমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী ২-১ মাসের মধ্যেই নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা। দ্বিতীয় রানওয়ের পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাডারের দরপত্র চূড়ান্তের পথে। এছাড়া কার্গোভিলেজের কাজ শেষ হয়ে গেছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের বর্তমান অবকাঠামোতে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি যাত্রী ও কার্গো বহন করা হচ্ছে। যে হারে যাত্রী ও কার্গো বাড়ছে তাতে আগামী ২০১৮ সালের পর পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে দ্রুতগতিতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিমানবন্দর যুগোপযোগী করা হচ্ছে। এ কাজের প্রধান সমন্বয়ক সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দুু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম সম্প্রতি জাইকার আমন্ত্রণে জাপান ঘুরে এসেছেন। ফিরে এসে প্রধান প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, থার্ড টার্মিনাল এখন আর স্বপ্ন নয়। আগামী বছরের মধ্যে এটি দৃশ্যমান হবে।

বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী হ্যান্ডলিং সক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ। গত অর্থবছরে ৬৭ লাখ যাত্রী এ বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে এবং যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ৫। বিমানবন্দরের বার্ষিক কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দুই লাখ টন, বর্তমানে এ বিমানবন্দর দিয়ে ২ লাখ ৩৭ হাজার টন কার্গো পরিবহন করা হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে বিমানবন্দরের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত কার্গো হ্যান্ডলিং হচ্ছে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত হওয়ায় পিক আওয়ারে হিমশিম খেতে হয়। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে কনভেয়ার বেল্ট পর্যন্ত সর্বত্র অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাইরের ক্যানপি থেকে পার্কিং কাউন্টার প্রতিটি পয়েন্টে থাকে অস্বাভাবিক ভিড়। একসঙ্গে ৬-৭টা ফ্লাইট নামলেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এদিকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রাডার ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দ্রুত প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন না করলে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে শাহজালালের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা। আধুনিক চাহিদার বিপরীতে বিদ্যমান রাডার ব্যবস্থাটি চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে পিপিপির (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মাধ্যমে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার জন্য একটি আনসলিসিটেড প্রস্তাব পায়। এরপরই সরকার এটি পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাডার স্থাপনের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। দেশী-বিদেশী মোট ৪টি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে দুটি প্রতিষ্ঠান নন-রেসপনসিভ হওয়ায় বাকি ২টি থেকে কারিগরি যোগ্যতার ভিত্তিতে একজনকে কার্যাদেশ দেয়া হবে। বর্তমানে পূর্ণ গতিতে প্রকল্পটির দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। আইকাও গাইড লাইন অনুযায়ী ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের সব বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলকভাবে যুগোপযোগী করতে হবে। এ বাধ্যবাধকতা মাথায় নিয়েই সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।