আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে কৃষি গবেষণা

দেশের সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর ধূসর চিত্রের মধ্যে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)। বেশ কিছু সাফল্য থাকা সংস্থাটি গবেষণা খাতে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। বিভিন্ন ফসলের ৪৭৯টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৪৪২টি ফসল উৎপাদন প্রযুক্তিসহ ৯২১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে সংস্থাটি। বাজেটের ৩৪ ভাগই গবেষণা খাতে ব্যয় করে তারা। বিগত ১০ বছরে তাদের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যা ৬৫০টি। গবেষণা ও উদ্ভাবনের বিভিন্ন সূচকে দেশের অন্য সরকারি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলোর তুলনায় এগিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জনবল, বাজেট বরাদ্দ, কেন্দ্র-উপকেন্দ্রের সংখ্যার দিক থেকেও এগিয়ে বিএআরআই।

১৯৭৬ সালে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু। সারাদেশে এর কেন্দ্র-উপকেন্দ্র ৫১টি। ধান, পাট, ইক্ষু ও চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলো এর অধীনে কাজ করে। গাজীপুরে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ১৭টি বিভাগ রয়েছে।

বিএআরআইর গবেষণার ক্ষেত্র সম্পর্কে সংস্থার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ ও বহুবিধ ফসলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটি। দানা শস্য, কন্দাল, ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফল, মসলা, ফুল ইত্যাদির উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন বিষয়ে এখানে গবেষণা হয়। এ ছাড়া মৃত্তিকা ও শস্য ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই-পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, পানি এবং সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন, খামার পদ্ধতির উন্নয়ন, শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং আর্থসামাজিক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও পরিমাণ নির্ধারণ বিষয়ে তারা গবেষণা করেন।

গবেষণায় এগিয়ে: বিএআরআই এ পর্যন্ত গমের ২৮টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে মহাজোট সরকারের সময়ে চারটি নতুন জাত (বারি গম ২৫, ২৬, ২৭ ও ২৮) উদ্ভাবিত হয়েছে, যেগুলোর ফলন হেক্টরে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ টন। দেশে পোলট্রি শিল্পের বিকাশের সঙ্গে ভুট্টার চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পর্যন্ত ১১টি হাইব্রিডসহ ১৯টি ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করেছে বিএআরআই।

কন্দাল ফসলের মধ্যে আলু, মিষ্টি আলু ও কচু ‘খাদ্য এবং সবজি’র ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংস্থাটি এ পর্যন্ত ৫৬টি উচ্চফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৫টি জাত (বারি আলু ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১) বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সংকরায়নের মাধ্যমে ক্লোনাল হাইব্রিড জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টন। যা প্রচলিত জাতগুলোর চেয়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি।

বিএআরই এ পর্যন্ত ৮টি তেলবীজ ফসলের ৪০টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বারি-১৬ লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ এলাকাতেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম। সবজির ঘাটতি পূরণের জন্য সংস্থাটি এ পর্যন্ত ২৯টি সবজি ফসলের মোট ৮৫টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বেগুনের দুটি হাইব্রিড ও গ্রীষ্মকালীন টমেটোর দুটি হাইব্রিড জাতও রয়েছে।

এ পর্যন্ত ২৬টি ‘ফল ফসল’-এর ৬২টি উন্নত জাতসহ ফল উৎপাদনের বেশ কিছু কলাকৌশলও উদ্ভাবিত হয়েছে। বিএআরআইতে মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের পর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের ২২টি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

দেশে ফুল গবেষণা একটি নতুন অধ্যায়। এর সম্ভাবনা চিহ্নিত করে বিএআরআই বিভিন্ন ফুলের ১৬টি জাত উদ্ভাবন করে। এর মধ্যে চন্দ্রমলি্লকার দুটি, এলপেনিয়ার একটি, গাঁদার একটি, লিলির একটি, ডালিয়া ও জারবেলার দুটি এবং গ্গ্নাডিওলাসের তিনটি জাত উল্লেখযোগ্য। ৩৩টি কৃষি যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে হাইস্পিড রোটারি টিলার, পাওয়ার টিলার চালিত ইনক্লাইন্ড প্লেট স্লিডার, বেড প্লান্টার, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, শক্তিচালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, শক্তিচালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র, যা কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

শুধু নতুন জাত উদ্ভাবন নয়, গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ এবং গবেষণা খাতে ব্যয়ের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে বিএআরআই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংস্থাটির বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৩০ কোটি ৫৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদ ৬৬ ভাগ এবং গবেষণা খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৪ ভাগ টাকা। বিগত ১০ বছরে সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ৬৫০টি গবেষণা নিবন্ধ পিআর রিভিউড (বিশ্বের বিভিন্ন অজানা গবেষক কর্তৃক পঠিত ও যাচাইকৃত) হয়েছে।

প্রতিবন্ধকতা: উল্লেখযোগ্য সফলতা থাকলেও এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিএআরআইর কর্তাব্যক্তিরা। এর মধ্যে জনবল সংকট অন্যতম। ইনস্টিটিউটে বর্তমানে অনুমোদিত জনবল ২ হাজার ৮৪১। এর মধ্যে বিজ্ঞানী ৭২৫ এবং বাকি দুই হাজার সাতজন অন্যান্য পদে কর্মরত। শূন্য পদ রয়েছে ১০৯টি।

এ ছাড়া হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল জাত উদ্ভাবন, ফসল ফলানো পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণ, জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, মাটির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং সমন্বিত পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), পাহাড়-উপকূলে চাষাবাদ, প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্স ইত্যাদিকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিএআরআইর মহাপরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল। তিনি বলেন, গবেষণার আরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এখন বিদেশি তহবিল কমে গেছে। নিজেদের টাকাতেই কাজ করতে হচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলোয় কর্মরত বিজ্ঞানীদের বয়সসীমা ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করার সরকারি প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়নও চান গবেষকরা।