নারীর ক্ষমতায়নে একটি বাড়ি একটি খামার

গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা ওতপ্রতোভাবে জড়িত। সমাজে বিদ্যমান নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার মূলে রয়েছে নারীর প্রতি বঞ্চনা আর অধিকারহীনতার ইতিহাস। আমাদের সমাজে নারীদের সব সময়ই নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। যার পরিণতিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানা ধরনের সামাজিক সমস্যাসহ নেতিবাচক ফলাফল বয়ে চলেছে। যুগ যুগ ধরে নারী নির্যাতনের কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নারীর পরনির্ভরশীলতা। পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা সব সময়ই থেকেছে অবহেলিত। পরিবারের ভালোমন্দ বিষয়ে নারীর কোনো মতামত নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হয়নি।

নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সন্তান গ্রহণ সবকিছুতেই প্রতিনিয়ত অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা এক পর্যায়ে নারীকে আত্মবিশ্বাসহীন করে তুলেছে। নারীকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে স্বীকৃতি দিতে অর্থাৎ নারীর মানবাধিকার রক্ষায় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে নারীর ক্ষমতায়নে রাখা হয়েছে নানা ধরনের কর্মসূচি। পৃথিবীতে কৃষির সূচনা নারীর হাতে। অনাদিকাল থেকে নারীকে ঘিরেই কৃষির আবর্তন। ফসল বোনা, ফসল কাটা, ঘরে তোলা, সংরক্ষণ সবই তার নিয়ন্ত্রণে। শুধু আর্থিক বিষয়টি পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি কাজে নারীর অংশগ্রহণ। কিন্তু ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে নারীকে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পুরো কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো নারী পরিবার পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন করবে। সিদ্ধান্ত নেয়ায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। অর্থের নিয়ন্ত্রণ থাকলে অসহায় নির্যাতনের শিকার হতে হবে না। আর সর্বোপরি সন্তান প্রতিপালনে নারীর আত্মবিশ্বাস ভারসাম্যপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখবে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক সুফল পেতে কৃষিবান্ধব কাজে তৃণমূলের জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যাত্রা। এটি প্রধানত দরিদ্র কৃষি পরিবারের জন্য বিশেষ কর্মসূচি। যেসব দরিদ্র পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার কিংবা প্রয়োজনীয় আর্থিক সক্ষমতা নেই, তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের এ বিশেষ উদ্যোগ। আর পারিবারিক পরিবেশে নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি কৃষি সেক্টরের বহুমুখী উন্নয়নেও এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। একটি বাড়ি যখন খামারে পরিণত হয়, তখন তা বহুমুখী সম্ভবনাকে কার্যকর করার ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাড়ির আঙিনার এক চিলতে জমি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় হয়ে উঠতে পারে পরিবারের সারা বছরের পুষ্টির নিয়মিত উৎস। এখানে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের পাশাপাশি একজন নারী গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন অথবা মাছের চাষ করেও সফল হতে পারেন। এমনিতেও ঘরের সামনের খোলা আঙিনায় মা-বোনেরা পালংশাক, লালশাক, মরিচ, বেগুন, টমেটো চারা রোপণ করে পারিবারিক নিয়মিত সবজির চাহিদা পূরণ করে থাকেন। তাছাড়া ঘরের চালে ও মাচায় লাউ, উচ্ছে, কুমড়া গাছ তুলে দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও বিক্রি করে বাড়তি আয় হয়। এসব অভিজ্ঞতার সঙ্গে গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার প্রশিক্ষণ এবং সরকারি ঋণ সহায়তা পেলে একজন নারী খামার বাড়িতে বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে প্রত্যয়ী হতে পারেন। খামার বাড়িতে আয়ের উৎস নারীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে তা আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে।

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে নারী তার নিজস্ব সক্ষমতা যাচাই করে চাহিদা, রুচি, জীবনযাপনের ধরন অনুযায়ী পছন্দ মাফিক কৃষিভিত্তিক যে কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। এ প্রকল্পে প্রথমত দরিদ্র এবং অনুন্নত পরিবারকে বাছাই করে ৬০টি ক্ষুদ্র কৃষি পরিবারের সমন্বয়ে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এসব ৬০টি পরিবারের প্রধান হবেন ৪০ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ। স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকারি প্রতিনিধি ও জনগণের মাধ্যমে গ্রামের উন্মুক্ত সভায় দরিদ্র এবং প্রান্তিক কৃষি পরিবার নির্বাচন করা হয়। যাদের ৩০ শতক অথবা ৫০ শতক জমি আছে কিংবা চরাঞ্চলে অথবা পার্বত্য অঞ্চলে যাদের ১০০ শতক জমি আছে তারাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খামারি হিসেবে অনুদানের জন্য আবেদন করবে।

নিজস্ব চাহিদা নিরূপণ করে সদস্যরা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত এককভাবে এবং যৌথ খামারিরা এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। সমিতির ৬০ জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনকে পাঁচটা প্রদর্শনী খামার তোলার জন্য কৃষি, নার্সারি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগির খামার এবং গবাদিপশু পালন এ পাঁচটি ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অন্য সদস্যরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কাছ থেকে একইভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়ে ওঠে। এভাবেই এই প্রকল্পে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। যার প্রভাবটা পড়ে নারীর ক্ষমতায়নে।
টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত দারিদ্র্য বিমোচন আর কর্মসংস্থান হলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান হাতিয়ার। পুরুষের পাশাপাশি নারীকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে মেয়েদের অধিকার রক্ষায় অনেক আইন হয়েছে। যেমন- যৌতুক নিরোধ আইন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, শিক্ষা সহায়তা ভাতা ইত্যাদি। এছাড়া ইভটিজিং রোধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দেয়া হলেও যতক্ষণ না অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে ততক্ষণ পরিপূর্ণ উন্নয়ন অর্থাৎ টেকসই মান অর্জিত হয় না। তাই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, নিজস্ব আয়ের ওপর অধিকার অর্জন ছাড়া নারীকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সম্ভব না। নারীর ক্ষমতায়নে দারিদ্র্য বিমোচন অগ্রাধিকার ভিত্তিক ইস্যু। ২০২১ সাল নাগাদ জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার মূল চ্যালেঞ্জ বর্তমানে দারিদ্র্য বিমোচন। টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দরকার নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগে উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে জীবিকায়ন। সরকারের লক্ষ্য হলো প্রতিটি পরিবারকে স্বনির্ভরতা অর্জনে সহায়তা করা।