তিন প্রকল্পে পাল্টে যাবে অর্থনীতি

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একের পর এক মহাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। যেগুলো খুবই দুঃসাহসিক ও ব্যাপক অর্থে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পও বটে, যা বাস্তবায়ন করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে।

অনেকের মতে, বাংলাদেশের মতো নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের জন্য যা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। এমনই কঠিন ও অবাস্তব বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার।

অনেকেই মনে করেন, শুধু ইস্পাত কঠিন মনোভাব আর নেতৃত্বের দক্ষতা ছাড়া কোনোভাবেই এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমে সব থেকে যা প্রয়োজন তা হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। সেই সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা তো বটেই। সরকারের নেওয়া বেশ কয়েকটি মহাপ্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প সত্যিকারভাবেই চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। কারণ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে হবে।

এছাড়া বিদ্যুৎ ও যানজট থেকে মুক্তি পেতে সরকারের আরো বেশ কয়েকটি মহাপরিকল্পনা এখন স্বপ্ন থেকে বাস্তবের পথে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামতের পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মনোযোগ দেয়। যার ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষ প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ পায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ। আর এখন পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকার বেশ কয়েকটি মহাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে।

অনেকেই মনে করে, সঠিক তদারকি আর দেশপ্রেম থাকলেই কেবল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে যে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি। বাড়বে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ। হাতছানি দিতে পারে বিদেশি বিনিয়োগ।

মেট্রোরেল নির্মাণ : রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের মানুষকে সীমাহীন যানজট থেকে মুক্ত করতে মহাপরিকল্পনা নিয়ে রাজধানীবাসীর জন্য মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই ও মাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।

২০১৭ সালের শুরুতেই মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০২০ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন থাকবে। এই পথ পাড়ি দিতে ট্রেনের সময় লাগবে ৩৬ মিনিট। মেট্রোরেলে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ : একটি দেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করে। আগামী বছর শুরু হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মূল কাজ।

রাশিয়ার প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে বহুলপ্রতীক্ষিত এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পের প্রাক-প্রস্তুতি ও অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে। আগামী ২০২২ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে এবং এই প্রকল্পের উৎপাদন কাজ শুরু হবে। এই পারমাণবিক প্রকল্পে ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

এই প্রকল্পে প্রথমে টানা ৬০ বছর পরবর্তীতে আরও ২০ বছর মোট ৮০ বছর উৎপাদন কাজ চলবে। এই প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয়ের ৯০ ভাগ অর্থ ঋণ দেবে রাশিয়া। বাকি ১০ ভাগ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে হবে। রাশিয়ার দেওয়া অর্থ পরিশোধের সময় হবে ২৮ বছর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৩ সালের মস্কো সফরের সময় রাশিয়ার সাথে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

বাগেরহাটের রামপালে সরকার আরেকটি বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ইতোমধ্যেই প্রাক-প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে।

এছাড়াও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্র বন্দরের পাশে ১৩২০ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বাস্তবায়নের পথে। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার প্লান্ট নামের এই প্রকল্পটি ২০১৯ সালের মধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক ১২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এ জন্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আলাদা দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্প দুটি হচ্ছে- ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইন পাওয়ার গ্রিড স্টেনদেনিং এবং মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন শীর্ষক প্রকল্প। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাতারবাড়ি কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমে চট্টগ্রামে আনা হবে। এরপরে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে এবং সবশেষে ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এনে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য প্রথমে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ১ হাজার ৯১ কোটি ৮১ লাখ টাকার মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইন পাওয়ার গ্রিড স্ট্রেনদেনিং নামে অন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের পর মাতারবাড়ির ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এনে সারাদেশে সরবরাহ করা হবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

পদ্মা সেতু : পদ্মা সেতু দেশের মানুষের কাছে আবেগ-অনুভূতির সেতু। আর সরকারের জন্য আত্মসম্মানের। কারণ এ সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে কম নাটক হয়নি। মামলা-হামলা সব কিছু মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। অনেকেই এ সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে মনে করেছিল।

কিন্তু সকল আলোচনা-সমালোচনাকে পিছনে ফেলে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতুর কাজ উদ্বোধন করেন। এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়।

নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী সরকার নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সেতুর ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে এবং যানবাহন চলাচল শুরু হবে।

এ বিষয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভোরের পাতাকে বলেন, ‘সকল বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করছি। আশা করি সবকিছু ঠিকঠাক মতোই শেষ হবে। সবার সহযোগিতায় পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারব।’