দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে সাঁড়াসী অভিযান। দুদকের এই অভিযানে আটক হচ্ছে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি। তবে স্মরণযোগ্য সময়ের মধ্যে এই প্রথম সরকারে পদস্থ কোনো কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ আমিনকে গ্রেফতার করে প্রশাসনে রীতিমতো ঝড় তুলেছে দুদক। এ নিয়ে গত ৫ মাসে প্রায় ৩ শ’ জনকে আটক করা হল।
এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ইত্তেফাককে বলেন, দুদকের তফশীলভুক্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা যে কোন আসামিকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় আইনে আবদ্ধ করতে পারে। তারা তাদের আইনী ক্ষমতা প্রয়োগ করবে এটাই তাদের দায়িত্ব। বরং এটি যদি কেউ না করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দূর করার জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দুদকের কর্মকর্তা নিয়োজিত আছে। এ ছাড়া ছয়টি আলাদা টিমও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর রাখছে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।
গতকাল সোমবার দুদক কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপসচিব, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী ও বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। ভিজিএফ কার্ডের খাদ্য আত্মসাতের অভিযোগ সম্প্রতি যশোরের একজন বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছে, গত ১৩ই মার্চ দুদকের নতুন চেয়াম্যান ইকবাল মাহমুদ যোগদান করার পর থেকে বিভিন্ন মামলার আসামিদের গ্রেফতারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়েছে। মামলা আছে কিন্তু জামিন না নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমন সকলকেই গ্রেফতার করা হবে বলেও জানান তারা।
দুদক সূত্র জানায়, গত ৬ মাসের দুদক বিভিন্ন মামলায় অন্তত ৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন অর্থ আত্মসাতের মামলার আসামি। এই অর্থ আত্মসাতজনিত অভিযোগে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১৭০ জন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে সরকারী কর্মকতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা রয়েছেন। প্রায় ৩৯ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ই জুলাই রাজধানীর পরিবাগ থেকে নাহার গার্ডেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে দুদক। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেজবাহুল করিমকেও গ্রেফতার করা হয়।
এছাড়া বেসরকারি নাগরিকদের দাপ্তরিক পাসপোর্ট দেয়ার অপরাধে গত ১৯ জুলাই ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম ও একই অফিসের উচ্চমান সহকারী সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় ১৯ পুলিশকে।
৩৬ কোটি কাটা আত্মসাতের অভিযোগে রূপসার চিফ সার্ভেয়ার ও ম্যানেজিং পার্টনার মো. শাহজাহান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া জীবন বীমা করপোরেশনের সাবেক ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার মো. নূরুল ইসলাম ভূঞা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ থেকে মো. গোলাম ফারুককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ না করে প্রায় ১৩ লাখ টাকার গম আত্মসাতের অভিযোগে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মুনিরুল ইসলাম। এছাড়া পাবনা থেকে ঠাকুরগাঁও সদরের সেটেলমেন্ট অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম, বগুড়া কালেক্টরেট কানুনগো কাজী আবু হেনা মোস্তফা কামাল, এলজিইডি কুষ্টিয়ার হিসাব রক্ষক শেখ সাফায়েত হোসেন, হবিগঞ্জ থেকে মো. সাজন মিয়া। অন্যের ২,৮৮,০৬৭ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির চেক প্রতারণার মাধ্যমে পূবালী ব্যাংকের টাকা উত্তোলনপূর্বক আত্মসাতের অভিযোগে ক্যাশ অফিসার মো. শামিম সরকারকে গ্রেফতার করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব গ্রেফতার: সর্বশেষ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব ড. মোহাম্মদ আমিন। গতকাল সোমবার ভোরে দুদকের উপ-পরিচালক আকতার হামিদ ভূঞার নেতৃত্বে একটি দল রাজধানীর মগবাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করে। গতকাল দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ঢাকা মহানগর হাকিম মেহের নিগার সূচনা এ আদেশ দেন।
দুদক সূত্র জানায়, দুদকের নোটিসের প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ আমিন ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিলকৃত ওই সম্পদ বিবরণীতে তিনি ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন যা তার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ বলে দুদকের কর্মকর্তারা প্রমাণ পায়। এরই প্রেক্ষিতে এ বছরের জুলাই মাসে দুদক তার বিরুদ্ধে ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিসিসির সাবেক প্রকৌশলী মজিবুর গ্রেফতার: সুইপার কলোনি নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলা ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী বর্তমান বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মো: মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মোট পৌনে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের ৫টি মামলা রয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর মগবাজার থেকে দুদক কর্মকতারা তাকে গ্রেফতার করে। গত ১৩ জুন দুদক উপ-পরিচালক এসএম রফিকুল ইসলাম রাজধানীর গেণ্ডারিয়া (ডিএমপি) থানায় বাদী হয়ে চারজনকে আসামী করে এ মামলাটি দায়ের করেন। এদিকে গতকাল সোমবার কুমিল্লার জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল বারেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনিসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে পেনশনারদের নামে জমাকৃত ১৬ কোটি আত্মসাতের অভিযোগে মামলা রয়েছে।