জঙ্গিবাদ উন্নয়নের পথে বাধা হতে পারে!

এমদাদুল ইসলাম: গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বর্বরোচিত জঙ্গি আক্রমণে ১৭ জন বিদেশি নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যার পর আবারও অনুরূপ কোনো হামলার আশঙ্কায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অজানা ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না, আর বিদেশিরা তো নিরাপত্তা ছাড়া বেরই হন না। ওই ঘটনা-উত্তর, বিশেষ করে বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্প বা যেসব প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার-উপদেষ্টা ও কর্মীরা কাজ করছেন সেখানে কমবেশি স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদানের পরও কাজের গতি নেই। কারণ হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নিহত বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সাতজন ছিল জাপানি প্রকৌশলী ও অন্যরা বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ, যারা ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করছিলেন। তন্মধ্যে একজন ছিলেন প্রায় ৮০ বছরের বয়স্ক মেট্রোরেল বিশেষজ্ঞ, যিনি তার এই পরিণত বয়সে নিজের দেশে আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করার জন্য এসেছিলেন। এর আগে রংপুরে আরেকজন জাপানি গবেষককে হত্যা করা হয়। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে এবং বর্তমানেও জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ-সমীক্ষা চলছে। তন্মধ্যে ঢাকা মেট্রোরেল, কক্সবাজারে মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক ১২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ উত্পাদন ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিনটি (শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর) বড় সেতু নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য।
এসব জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার (ঋধংঃ ঞত্ধপশ উবাবষড়ঢ়সবহঃ) তালিকারও আওতাভুক্ত, যা নিয়মিত সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং করা হয়। রাজধানী ঢাকার ভয়াবহ যানজট সমস্যা নিরসনে দীর্ঘদিন চেষ্টা-তদবিরের পর জাপান সরকারের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় গত জুন মাসের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী গজঞ-৬ মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজের শুভ উদ্বোধন করেন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাস্তবায়িতব্য এই প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ (উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত) আগামী ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। সে অনুসারে সম্প্রতি উত্তরায় ডিপো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে এবং অচিরে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও পূর্ণোদ্যমে শুরু হওয়ার কথা। পাশাপাশি জাপান সরকারের সহযোগিতায় গজঞ-২ ও গজঞ-৫ প্রকল্পের বাস্তবায়নে অনেক জাপানি নাগরিক ঢাকায় সমীক্ষার কাজ করছিলেন, যাদের সাতজন হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের আক্রমণে নিহত হন। অনুরূপ মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদন এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে সমীক্ষা ও ডিজাইন প্রণয়নে আরও অনেক জাপানি নাগরিক কাজ করছেন। কিন্তু হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা বেছে বেছে বিদেশিদের নির্মমভাবে হত্যা করাকে কেন্দ্র করে শুধু জাপানিজ ও ইতালিয়ান নয়, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অপরাপর অনেক বিদেশিও দেশ ছেড়েছেন বা ছুটিতে চলে গেছেন। সরকারের গৃহীত নিরাপত্তাব্যবস্থায় বিদেশিরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি তো দেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারেই তাদের লোকজনের নিরাপত্তা বিধানের দাবি করেছেন। বিদেশিদের সঙ্গে গানম্যান রাখা ও আর্মার্ড ভেহিকল নিয়ে চলার অনুমতি প্রদানের জন্যও বলেছেন। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নাধীন ও অচিরে গৃহীতব্য মেগা প্রকল্পের কাজ যে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমনিতে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের অভাব নিয়ে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর বরাবর অভিযোগ। তার মধ্যে হালে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিস্তার ও বিদেশিদের ওপর বর্বর আক্রমণ নিয়ে অশনি সঙ্কেতের সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা তথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কোনো সরকারের আমলেই দেশে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিরও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটেনি, যদিও এর পেছনে যথাযথভাবে সমীক্ষা ব্যতিরেকে প্রকল্প গ্রহণ, অগ্রাধিকার নির্ধারণে হেরফের, প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ, অপ্রতুল বরাদ্দ, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় সমভাবে দায়ী। এটাও লক্ষণীয়, সরকার পরিবর্তনের পর প্রায়শ দেশে প্রকল্পের অগ্রাধিকার পরিবর্তন হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্পের ভালো-মন্দ বিচার না করেই তা স্থগিত বা বাতিলও করে দেওয়া হয়। আবার দেশের উন্নয়নে বৈষম্য বা অসামঞ্জস্য উন্নয়নেরও নজির আছে অর্থাত্ যেখানে যা হওয়ার নয়, সেখানে তা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইদানীং অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত বা সমীক্ষার আলোকে প্রকল্প গৃহীত হয় না, এমনকি কিছু মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন-নির্মাণকাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে সম্ভাবিত সমীক্ষা ছাড়াই। বাস্তবে এসব অসঙ্গতিতে বারবার প্রকল্প সংশোধন, বরাদ্দে কাট-ছাঁট, অসমন্বিত উন্নয়ন ইত্যাদির কারণে শ্লথগতিতে কোনো প্রকল্পই কাঙ্ক্ষিত সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিস্তার ও বাড়াবাড়িতে দেশের উন্নয়নে ভিন্নমাত্রার সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
অবশ্য বিষয়টিকে এখন বৈশ্বিক সমস্যাও বলা যায়। বিভিন্ন ধরনের অপরাজনীতিতে এখন অনেক দেশেই সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি আক্রমণ হচ্ছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরান-ইরাক ও সিরিয়ায় তো তা সর্বক্ষণই লেগেই আছে। ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরান-ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় মদদে (!) বা স্বপ্রণোদিত হয়েও অনেক বাংলাদেশি সহমত পোষণ করে যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন। অতঃপর তাদের অনেকে দেশে ফিরে আসার পর উগ্র মৌলবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ছত্রছায়ায় ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে দেশের বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয় এবং তারা অনেক জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের কোমলমতি ছাত্র ও তরুণসমাজকেও এসব অপকর্মে উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে থাকে। প্রথমদিকে মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে এই কাজে ব্যবহার করা হয়; যখন পর্যায়ক্রমে আল্লাহর দল, হিযবুত তাহরীর, হুজি, হুজি-বি, আনসারুল্লাহ টিম, জেএমবি ইত্যাদি বিভিন্ন চমকপ্রদ নামে দেশের স্থানে স্থানে তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়। এদের সর্বশেষ ভার্সন হল বহুল আলোচিত ‘আইএস’। বলা হয়, ইরান ও সিরিয়া থেকে বিতাড়িত বা প্রত্যাগত ঘরবাড়িহারা মানুষগুলোর অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে আশ্রয় নিয়ে এই আইএসের জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, আইএস সংশ্লিষ্ট কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় মদদেও সৃষ্ট! অথচ প্রায় ক্ষেত্রে বিগত বছরসমূহে বিশ্বের যখন যেখানে যা ঘটেছে, তার অপকর্মের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হোতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর প্রথমদিকে এই অপকর্মটি শুধু এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালক্রমে এখন এটি ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যেও বিস্তৃ্তত অর্থাত্ বর্তমানে পুরো বিশ্বই জঙ্গিবাদের খপ্পরে পড়ে গেছে। প্রচণ্ড নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেও যেখানে কখনও কেউ যা চিন্তে করেনি, জঙ্গিরা এখন সেখানে তাই করে চলেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বিভিন্নভাবে। একে তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনৈক্যে অনেক দেশ তথা দাতা সংস্থাগুলো আমাদেরকে নিয়ে বিভিন্নভাবে খেলছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনাকে লক্ষ্য করে একটি মহল বিভিন্নভাবে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা চায় না, বাংলাদেশ মাথা উঁচু হয়ে দাঁড়াক ও আরও এগিয়ে যাক। অপরদিকে কিছু বিশ্বশক্তির মদদে দেশের ভেতর উগ্রবাদী রাজনীতি বহাল রেখে ধারাবাহিক অস্থিরতা বজায় রাখা হয়েছে। অনেকের মতে, এভাবে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশে ধর্মান্ধতা আগেও ছিল এখনও আছে, কিন্তু আগে কখনও ধর্মান্ধ লোকজনের বাড়াবাড়িতে উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা স্থবির হয়ে পড়ার কথা শোনা যায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ধর্মান্ধতার মধ্যেও উন্নয়ন হয়েছে ও হয়ে চলেছে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলটি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে জঙ্গিবাদের গ্যাঁড়াকলে ঠেলে দিচ্ছে। হলি আর্টিজানের বর্বরোচিত ঘটনাটির পর শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে জঙ্গিদের আক্রমণ, অতঃপর কল্যাণপুরের জনাকীর্ণ এলাকায় জঙ্গিদের আক্রমণের প্রস্তুতিকালে তা প্রতিহত করার পর দেশের আপামর মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সবার মধ্যে জঙ্গি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
প্রসঙ্গক্রমে, এখানে দেশে জঙ্গির উত্পত্তি নিয়েও একটু আলোকপাত করা যায়। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশ-গ্রামের সাধারণ মানুষ নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষা ও মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য যেভাবে জঙ্গিরূপ ধারণ করে বীরের মতো যুদ্ধ করেছেন তা অনেকটা ধর্মীয় যুদ্ধের মতোই ছিল। এজন্য সন্মুখ মুক্তিযোদ্ধারা তো নিজেদেরকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং বিষয়টি রাষ্ট্রীয় ও স্বীকৃত। আর ধর্মের বাহাস তুলে যে কুচক্রী মহলটি (জামায়াত-শিবির, আলবদর, রাজাকার ইত্যাদি) আমাদের মা-বোনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তারা আখ্যায়িত হয়েছে স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী হিসেবে। অথচ কালক্রমে দেশের নষ্ট রাজনীতিতে এই দুষ্ট চক্রটি বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার সহযোগী ও অংশীদার হয়ে এবং তাদের মদদেই তরুণসমাজকে প্রলুব্ধ করে উগ্র ধর্মান্ধতার সৃষ্টি করা হয়। এভাবে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী সংগঠনের জন্ম ও বিস্তার ঘটতে থাকে। লক্ষ করলে দেখা যায়, বিশ্বের কিছু দেশে এ ধরনের কিছু অতি ধর্মান্ধ লোক কর্তৃক তথাকথিত ধর্মযুদ্ধের নামে নতুন প্রজন্মকে, বিশেষ করে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ব্রেনওয়াশ করে তাদেরকে দিয়ে যতসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক, অনেকে বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়েও এই চক্রের ফাঁদে পড়েছে, যা আমরা সাম্প্রতিককালে দেশীয় কিছু জঙ্গির মধ্যে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, আগে এই দুষ্ট চক্রের ফাঁদে পড়েছিল অল্প শিক্ষিত ও মাদ্রাসার ছাত্ররা। আর এখন তারা টার্গেট করেছে ভদ্র ঘরের ও শিক্ষিত তরুণদেরকে। এভাবে সৃষ্ট জঙ্গিদেরকে দিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে যতসব কুকাজ ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে এখন মুসলমানদের একটা সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত করার বহুবিধ ষড়যন্ত্র চলছে।
এ কথা সত্য, মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উন্নয়নেও একটি ভালো গতির সঞ্চার হয়েছিল। গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, বহুমাত্রিক শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকলে বাংলাদেশ এতদিনে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনৈক্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। ২০০৭ সালে এই বিষয়টিকে পুঁজি করে ক্ষমতা দখলকারী এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই মর্মে ঐক্য হয়েছিল-যে দল বা যারাই আগামীতে ক্ষমতায় যাক না কেন, তারা সমন্বিতভাবে কাজ করবে, দেশের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় কেউ তাদের কথা রাখেনি। আর গতানুগতিক রাজনীতিতে যে দল বিরোধী দলে থাকে তারা তো বরাবর দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেই ক্ষমতায় যেতে চায়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি তো আছেই। যেমন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা প্রদানে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পিছিয়ে যায়।
২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বেশ কিছু বড় আকারের উন্নয়নকাজের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ছিল। তন্মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের আধুনিকায়ন, একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ, রাজধানী ঢাকায় পাতালরেল, মনোরেল, মেট্রোরেল, সার্কুলার রেলপথ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনোত্তর সরকার প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালায়। কতিপয় ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। কিন্তু বহুল আকাঙ্ক্ষিত চচচ ব্যবস্থা আজ অবধি তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। দেশ-বিদেশের অনেক উদ্যোক্তা আগ্রহ নিয়ে এসে দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখে পিছিয়ে যায়। তাছাড়া কিছু মেগা প্রকল্প নিয়ে নতুন ধরনের রাজনীতিও শুরু হয়েছে। যেমন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চেয়ে এখন সরকার খুলনার পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। এভাবে অগ্রাধিকার তালিকায় হেরফের, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশসমূহের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন, ঋণ সহায়তা প্রদানে বিভিন্ন ধরনের বাড়তি শর্তারোপ ইত্যাদি কারণেও দেশের উন্নয়নে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে।
আর এখন তো সবকিছুতেই কথা আর কথা। যার যা বলার নয়, তিনি বা তারাও সবকিছু নিয়ে কথা বলেন। আর এভাবে কথামালার রাজনীতিতে জড়িয়ে কিছু প্রকল্পের কাজ অনেকদূর এগিয়েও বাস্তবায়িত হয়নি। অতিকথনের কারণে আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধুর নামে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনার অকালমৃত্যু হয়। আর কেন জানি, আমাদের এই দেশে বরাবর বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের মতামত উপেক্ষিত। আমলারা তো প্রকৌশলীদের বরাবর আড় চোখেই দেখেন এবং নিজেদের সর্বজান্তা ভাবেন। এই প্রক্রিয়ায় ইদানীং উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবেও নিয়োগ পাচ্ছেন আমলারা। যেমন ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবে কারিগরি উন্নয়ন প্রকল্প হলেও এটির প্রকল্প পরিচালক হয়ে আছেন একজন আমলা। এতে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি আসবে। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীরাও এখন পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে গেছে। অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে যেকোনো কিছুর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করাও যেন একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। আর বিরোধী দলের তো সদা সর্বদা সরকারের সবকিছুতেই ‘না’ আর ‘না’! যে যত বেশি ‘না’ বলে অর্থাত্ নেতিবাচক রাজনীতি করে, আবেগপ্রবণ বাঙালিরা আবার তাদেরকেই বেশি ভোট দেয়, পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচিত করে। কে জানে, দেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আবার এর কারণেও সৃষ্ট কি না! স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতিতে দেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রে পতিত হন। আওয়ামী লীগের দলীয় মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ তো ইতোমধ্যে সে রকম একটা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যও করে বসেছেন।
কথায় বলে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। হলি আর্টিজানে ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত জাপানি লোকজনের মৃত্যুর পর তাত্ক্ষণিকভাবে জাপান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহায়তা থেকে পিছিয়ে যাবে না। আগে উল্লেখ করেছি, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে কিছু বিশ্ব ‘মুরব্বি’ ভালো চোখে দেখছে না। তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে অবদমিত রেখে এখানে নিজেদের মার্কেট সৃষ্টি করতে চায় বা নিজেদের দেশে ব্যবসা নিয়ে যেতে চায়। এজন্য অনেকে তো দেশে সাম্প্রতিককালে জঙ্গিবাদের উত্থান ও ধ্বংসাত্মক অপকর্মকে ওইসব দেশ তথা ‘মুরব্বি’দের খেল হিসেবেও মনে করছেন! কেউ কেউ তো এ-ও বলছেন, এসব শিক্ষিত জঙ্গিকে সংশ্লিষ্ট দেশে ট্রেনিং দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। তারা যেন বিদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করে ভয়-আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে!
লেখক : নগর উন্নয়ন বিশ্লেষক