বাংলাদেশ ও হাসিনা নেতৃত্ব

কয়েকদিন আগে ঢাকার একটি দৈনিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলাম এই পররাষ্ট্র নীতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন প্রভাবশালী নেতৃপদে অধিষ্ঠিত করেছে। আমার এই মন্তব্যটি ঢাকার কয়েকজন পাঠকের পছন্দ হয়নি। তারা বিএনপি’র সমর্থক কিনা তা আমি জানি না। কোনো পরিচয় তারা দেননি। কেবল জানিয়েছেন, তারা আমার লেখার নিয়মিত পাঠক। তাদের অভিযোগ, আমি আবশ্যকভাবে শেখ হাসিনার প্রশংসা করি। তার সাফল্যের কথা অতিরঞ্জিত করি। তার প্রমাণ, সম্প্রতি হাসিনা সরকারের বিদেশ নীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছি, যা এই সরকারের প্রাপ্য নয়। পত্র লেখকেরা প্রশ্ন রেখেছেন, পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের বিদেশ নীতির সঙ্গে বর্তমান হাসিনা সরকারের বিদেশ নীতির পার্থক্যটা কোথায়?

আমি হাসিনা সরকারের সাফল্যগুলোর প্রশংসা করি একথা সত্য। তাদের ব্যর্থতাগুলোরও কথা বলি। তবে তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অতিরঞ্জিত করি না। কী ধরনের জটিল জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় পরিস্থিতিতে হাসিনা সরকারের অনেক প্রচেষ্টা সফল হয় না, সে কথা লেখার সময় স্মরণে রাখি। অতীতের বিএনপি সরকার এবং বর্তমানের আওয়ামী সরকারের বিদেশ নীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এমন কথা কী করে লিখি? বিএনপি সরকারের আদৌ কোনো জাতীয় পররাষ্ট্র নীতি ছিল কি? অন্ধ মার্কিন তাঁবেদারি, সউদি আরব ও পাকিস্তানের সঙ্গে “বশ্যতামূলক বন্ধুত্ব” এবং পাকিস্তানের স্বার্থে ভারত-বিদ্বেষী নীতি অনুসরণ দ্বারা বাংলাদেশের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে নামানো হয়েছিল সেকথা আমার এই পাঠক বন্ধুরা কি অনুধাবন করেন?

তাছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কি গ্রহণ করতে পেরেছেন, নিজের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করতে পেরেছেন, না, কোনো সমস্যায় কোনো অবস্থান গ্রহণ করতে পেরেছেন? বাংলাদেশের বাইরে খালেদা জিয়া এই নামটি কোথায় পরিচিত? কোনো আন্তর্জাতিক পদক বা পদবিও তার ভাগ্যে জোটেনি। অন্যদিকে শেখ হাসিনা এই নামটি আজ বিশ্বময় পরিচিত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের সাফল্যের কথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন।

যে আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন বঙ্গবন্ধু হত্যায় মদদ জুগিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, সেই আমেরিকার বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি ঢাকা সফরে এসে বলেছেন, “বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত হবে।” এটা কোনো মার্কিন নেতার পক্ষে বলা সম্ভব হতো না, যদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার বিদেশনীতি সফল না হতো এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ না করতো। দেশের ভেতর অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং সন্ত্রাস দমনে হাসিনা সরকারের সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব শান্তিরক্ষা এবং বিশ্ব পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নেতৃত্বদানে তার অগ্রণী ভূমিকা। এ জন্যে নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মানেও তিনি ভূষিত হয়েছেন। এই সম্মান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও সম্মান ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বিএনপি বা খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে এর কোনোটাই বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটেনি।

এসব কথা বলা কি শেখ হাসিনা বা তার সরকারের অহেতুক প্রশংসা করা বা এই সরকারের সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো? বিএনপি’র সরকারগুলোর আমলে (জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়া) পাকিস্তানের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে ঝগড়া করা হয়েছে, (যেমন পূর্ব সীমান্তে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ জোগানো)। কিন্তু গঙ্গার পানির এক ফোঁটা আদায় করা সম্ভব হয়নি। ছিটমহল সমস্যা অমীমাংসিত রয়েছে। স্থল সীমান্ত চুক্তি ফাইলবন্দী রয়েছে। সীমান্ত সংঘর্ষ ও নিরীহ মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে।

হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে শান্তিপূর্ণভাবে দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টায় এই সমস্যাগুলোর অধিকাংশের মীমাংসা করেছেন। বাংলাদেশের নিকট এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত। সেকথা স্মরণে রেখে দেশের সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দিল্লির বিজেপির মতো সরকারের সঙ্গে পর্যন্ত শেখ হাসিনা দৃঢ় মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ বিএনপি আশা করেছিল, দিল্লির বিজেপি সরকারের আনুকূল্যে তারা হাসিনা সরকারের ভিত নড়িয়ে দিতে পারবেন। বাস্তবে বাতাস বইছে হাসিনা সরকারের অনুকূলে। এটা কি তার বিদেশনীতি বা ভারত নীতির বিরাট সাফল্য নয়?

বহুদিন ধরে একটা চিরাচরিত ধারণা ছিল, আমেরিকা, চীন এবং সউদি আরব, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেয়নি, তারা আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এবং তিনটি দেশেরই অনুকূল মনোভাব বিএনপির প্রতি। তারা বিএনপি এবং বিএনপি সরকারের ‘ন্যাচারাল এলাই।’ এই ধারণা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক হাসিনা সরকার এই মিথটি ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। হাসিনা সরকারের বিদেশনীতির অভাবনীয় সাফল্য এই যে, এই তিনটি দেশই এখন বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রক্ষায় আগ্রহী।

বাংলাদেশের গত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি নানা অজুহাতে যোগ না দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল এই নির্বাচন অবৈধ এবং এই নির্বাচনের দ্বারা গঠিত সরকারও অবৈধ। বিএনপি আশা করেছিল, বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো-বিশেষ করে আমেরিকা, সৌদি আরব, চীন ও জাপান, সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা এবং হাসিনা সরকারের বৈধতা স্বীকার করবে না এবং অবিলম্বে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শেখ হাসিনার উপর প্রচণ্ড চাপ দেবে।

বিএনপি’র এই আশাও সফল হয়নি। হাসিনা সরকারের সঙ্গে আমেরিকা আরো ঘনিষ্ঠ হতে চায় এই বার্তা নিয়ে জন কেরি সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। জাপান বাংলাদেশকে আরো অর্থনৈতিক সাহায্যদানে আগ্রহী। নয়া চীন হাসিনা সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সর্বপ্রকার সাহায্য দানে এগিয়ে এসেছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষায় হাসিনা সরকার চমত্কার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যে সৌদি সরকার কখনোই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখায়নি বরং ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের দণ্ডদানের ছিল ঘোর বিরোধী; সেই সৌদি সরকার এখন আগের মনোভাব পাল্টেছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের একের পর এক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার সঙ্গে সঙ্গে আরো ৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে নিতে সম্মত হয়েছে।

’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান নিয়ে তুরস্কের এরদোয়ান সরকার সম্প্রতি প্রচণ্ড বাংলাদেশ-বিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর তার প্রতিবাদে তুরস্ক ঢাকায় নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূত দেউরিম ওজতুর্ককে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকিও আঙ্কারা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মনে হয়েছিল তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বুঝি ছিন্ন হতে চলেছে। এই অবস্থাতেও এরদোয়ান সরকারের চাপের কাছে শেখ হাসিনা মাথা নিচু করেননি। তিনি তুরস্ক সরকারকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে দেননি।

বাংলাদেশের এই দৃঢ়তার কাছে এরদোয়ান সরকারই এখন পিছু হটেছেন। তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নিজেই এখন তার দেশে মৃত্যুদণ্ডদানের পক্ষে কথা বলছেন। তার দূত ওজতুর্ক ঢাকায় ফিরে এসেছেন এবং বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাতে নাক গলানোর কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই।’ শুধু তাই নয়, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধু হত্যারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করায় শেখ হাসিনার কাছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

এমনকি এরদোয়ান এখন বলছেন, ‘দেশের সংবিধানে যদি প্রত্যেক ধর্মের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হয়, তাহলে কেবল ইসলামকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই। যদি ইহুদি, মুসলমান, খ্রিষ্টান ও নাস্তিক সকলেই নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে একটি দেশে বাস করতে পারেন। তাহলেতো কোনো সমস্যা থাকারই কথা নয়।’ কথায় বলে মানুষ দেখে শেখে না, ঠেকে শেখে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বেলায় কথাটি সত্য। তিনি ঠেকে শিখেছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতাই হচ্ছে সকল ধর্মের নিরাপত্তার শ্রেষ্ঠ গ্যারান্টি। তিনি হয়তো এতোদিনে ঠেকে শিখেছেন, তুরস্ককে ধর্ম নিরপেক্ষতার পথ থেকে সরিয়ে এনে সঠিক কাজ করেননি। এই শিক্ষাটি তিনি সম্ভবত বাংলাদেশের কাছ থেকেও নিয়েছেন।

সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অবস্থানটি আপসহীন। এই ব্যাপারে তিনি একবার জাতিসংঘে প্রস্তাব তুলেছিলেন, কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হলে যেন তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তার এই প্রস্তাব শুনে পাকিস্তানের তখনকার সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নাখোশ হয়েছিলেন। তিনি এখন পতিত স্বৈরাচারী। আর শেখ হাসিনা এখনো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

সমালোচকেরা যাই বলুন, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এই নেতৃত্বের কোনো ব্যর্থতা নেই তা বলব না, কিন্তু সাফল্যটাই বড়। এই সাফল্যই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার নেতৃত্বকে গুরুত্ব ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশেরও গুরুত্ব ও মর্যাদা বাড়িয়েছে। এই সত্যটি স্বীকার করতে তার সমালোচকদেরও দ্বিধা করা উচিত নয়।