যেসব গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং ধর্মের নামে এক ধরনের নেশায় বুঁদ করে সম্ভাবনাময় তরুণদের খুনি বানাচ্ছে তারা ভয়ংকর অমানবিক লোভী গোত্রের মানুষ। নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করতে বিভ্রান্ত করছে তরুণদের। বেছে বেছে বের করছে সেই সব তরুণ-তরুণীকে, যাদের মধ্যে একটি ধর্মপ্রবণ মন আছে অথচ ধর্ম সম্পর্কে গভীর চর্চা নেই। যদি সচেতন বিবেকবান ও জ্ঞানচর্চায় যুক্ত স্বাভাবিক মানসিকতার তরুণ হতো, তবে তাদের মনে যুক্তি ভর করত। ধর্মের প্রকৃত সত্য প্রকৃত শিক্ষা জানার চেষ্টা করত কোরআন-হাদিস চর্চার মধ্য দিয়ে। আবার এই সত্যটিও জানা উচিত, নিজ ধর্মকে জানতে ও বুঝতে হলে তাকে অবশ্যই তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে চর্চা করতে হবে। এ পথেই প্রকৃত জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হওয়ার কথা। এভাবে একজন মানুষ ধার্মিক হতে পারেন কিন্তু ধর্মান্ধ হবেন না কখনো। কিন্তু যেসব অসাধু মানুষ আন্তর্জাতিক চক্রের আজ্ঞাবহ হয়ে জঙ্গিবাদের দীক্ষা দিচ্ছে, তাদের প্রকৃত ধর্মচর্চা করা কোনো ধার্মিক মানুষের প্রয়োজন নেই। তারা খুঁজে বেড়ায় ধর্মপ্রবণ মনের তরুণ-তরুণীদের, যারা প্রকৃত ধর্মচর্চায় গোমূর্খ। এদের কাছে পরিকল্পিতভাবে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে আসে। ধর্মের মূল গ্রন্থ পাঠের বদলে নিজেদের আদর্শিক ব্যাখ্যায় লেখা জিহাদি বই সামনে তুলে ধরে। আর এসব তরুণ এগুলোকেই ধর্মের নির্দেশনা মেনে বিভ্রান্ত হয়। নিজেদের লোভের ফসল ঘরে তুলতে মনগড়া ওয়াজে অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। যে ইসলাম মানুষ খুন করাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, সেই ইসলামের নামেই তরুণদের খুনি বানায়। যে ধর্মে পবিত্র মহাগ্রন্থে কে পাপী কে পুণ্যবান তা নির্ধারণের দায়িত্ব একমাত্র মহান আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত এবং কাকে মার্জনা করবেন আর কাকে শাস্তি দেবেন সে অধিকারও একমাত্র আল্লাহই সংরক্ষণ করেন, সেখানে জঙ্গিরা যখন নিরীহ মানুষদের কাফের বিবেচনা করে নির্বিচারে হত্যা করে তখন তাদের এই আচরণ যে ‘শেরেকি’তে পরিণত হয় এবং ধর্মবিচারে মহাপাপের কাজ হয়, এসব বোঝার মতো মানসিক ভারসাম্য এই তরুণদের থাকে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। এসব জঙ্গির হোতা বা পরিচালকরা যদি ধর্মের প্রয়োজনেই বা ইসলাম সুরক্ষার জন্য আদর্শিক আন্দোলন করত, তবে এর রূপ অন্তত মানবতাবিরোধী অপরাধে পর্যবসিত হতো না। উনিশ শতকে হাজি শরীয়তুল্লাহ ওয়াহাবি মতাদর্শের আলোকে ইসলাম রক্ষার স্লোগানে ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে যাননি। তিনি দীর্ঘদিন মক্কায় অবস্থানকালে ওয়াহাবি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হন। বাংলায় ফিরে ইংরেজদের হাতে পরাধীন দেশ তিনি দেখেছিলেন। প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। আবার ভারতবর্ষে যাতে মুসলিম রাজত্ব ফিরে আসে তার পথ খোঁজেন তিনি। যুক্তি-বুদ্ধি ও বাস্তবতার নিরিখে তিনি সময়ের মূল্যায়ন করেন। বুঝতে পারেন এখন মুসলমানদের এত শক্তি নেই যে ইংরেজদের তাড়াতে পারবে। তা ছাড়া বাংলার মুসলমানদের বড় অংশই হিন্দু-বৌদ্ধ ও লৌকিক ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে মৌলিক চরিত্রে আর নেই। সুতরাং মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতির বলয়ে ঐক্যবদ্ধ করাটা তিনি প্রথম কর্তব্য মনে করলেন। উনিশ শতকে একজন ওয়াহাবি চেতনার ধারক মৌলবাদী হাজি শরীয়তুল্লাহ মানুষ হত্যা করে আর অরাজকতা সৃষ্টি করে ইসলামী শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাননি। অথচ একুশ শতকের ইসলামী জঙ্গি পরিচয়ধারী অমানবিক মানুষরা ইসলামের সৌন্দর্যকে কলুষিত করে বিভ্রান্ত করছে এক শ্রেণির তরুণকে। ধর্মের নামে তাদের খুনি বানাচ্ছে। এই বাস্তবতা একটু গভীরভাবে বুঝতে চাইলে স্পষ্ট হবে। হাজি শরীয়তুল্লাহ নিজ ধর্মীয় মৌলবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলাম রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সঠিক কি বেঠিক তা ভিন্ন মূল্যায়ন। তবে তিনি তাঁর আন্দোলনে ধর্মের নামে কোনো অধর্ম করেননি। কিন্তু এ সময়ের তথাকথিত শিক্ষিত জঙ্গিরা যখন ইসলাম রক্ষার নামে ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী তৎপরতায় যুক্ত হয়, তখন বুঝতে হবে এর পেছনে বৃহত্তর কোনো ষড়যন্ত্র আছে। ধর্ম শুধু উপলক্ষ মাত্র। ফরায়েজী আন্দোলন তেমন একটা সাফল্য পায়নি। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত জানা থাকলে মানতে হবে সাফল্য পাওয়া সম্ভবও নয়। বাংলার মানুষকে মৌলবাদী মুসলমান বানানো কঠিন। কারণ এ দেশের মানুষ হাজার বছর ধরে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। মরমিবাদ তাদের মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে তুলেছে। বাঙালির যাপিত জীবনে মরমিবাদী সহজিয়া ধারার প্রভাব প্রবল। সেই প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মে নাথ মতবাদের মতো মরমি ধারা বাঙালি সমাজের একাংশকে আলোড়িত করেছিল। সেন যুগে কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদ মানুষকে বিতৃষ্ণ করে তোলে। প্রেমহীন সমাজে সাধারণ বাঙালির জীবন যখন ওষ্ঠাগত, তখন বিপন্ন শূদ্র-বাঙালির সামনে অপেক্ষাকৃত ভালো আশ্রয়ের সন্ধান নিয়ে এসেছিলেন মরমিবাদী সুফি-সাধকরা। ইসলামী দর্শন ও জ্ঞানে উজ্জ্বল এই সুফিরা ইসলামের মানবিক রূপটি মেলে ধরতে পেরেছিলেন। কোনো হিংসা নয়—মানব প্রেমই যে আল্লাহ প্রেমের পথ, এই সত্যটি মানুষের সামনে স্পষ্ট করতে পেরেছিলেন সুফিরা। তাই মানবতার বিজয় হয়েছে। প্রায় ৫০০ বছর স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে সুফিদের আশ্রয়ে এসে। এভাবে হিন্দু সমাজের যখন ক্ষয়িষ্ণু দশা, তখন হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে। এই মরমি ধারাও জনপ্রিয়তা পেল। সুফিদের মতোই মানবিকতার আদর্শ ছিল চৈতন্যের সাধন ধারায়। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে যে মরমি ও মানবতাবাদী দর্শন ও জীবনবোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে বাঙালি, তাকে জঙ্গিবাদী ভীতি দিয়ে জিহাদি বানানো সম্ভব নয়। তাই ইতিহাসের সূত্রেই বলতে হবে সাময়িকভাবে শঙ্কা ছড়ালেও এ দেশে জঙ্গিবাদ শক্ত মাটি পাবে না। সাধারণ মানুষের সমর্থন ছাড়া কোনো আদর্শের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই যে জেএমবির উত্থান এবং আরো সব নানা নামের জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে, এদের কারো পেছনেই কি সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বড় অংশই ধার্মিক, তবে ধর্মান্ধ নয়। শহরাঞ্চল থেকে গ্রাম, কোথাও তেমন মানুষ পাওয়া যাবে না যারা জঙ্গি নামধারীদের হাতে মানুষ খুনকে সমর্থন দেবে। গুলশান ট্র্যাজেডির পর থেকে জঙ্গিদের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা আমরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ও মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। এটিই হচ্ছে জঙ্গিদের জন্য দুঃসংবাদ। এ দেশের মাটি আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো নিরেট নয়। দীর্ঘকাল ধরে মানবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষই জঙ্গিদের রুখে দিতে সক্ষম। জনসমর্থনবিহীন আত্মগোপনে থাকা এসব জঙ্গি দু-চারটি খুন করে সাময়িক সংকট তৈরি করতে পারলেও এদের ধ্বংস অনিবার্য। এই বাস্তবতায় কোনো রাজনৈতিক ঐক্যের মতলবি ডাক নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সাধারণ মানুষের ঐক্য রয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। এখন সরকারি নীতি যদি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অটুট থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে যদি জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারে তাহলে জঙ্গিদের নির্মূল করা কঠিন হবে না। একটু একটু করে নানা নামে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের কথা শুনি—অঙ্কুরেই এদের মূলোচ্ছেদ করতে হবে। নবরূপে দাঁড়ানো জঙ্গিদের এক মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নিহত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। বাকি বরখাস্ত হওয়া সেনাবাহিনীর মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও মারজানের গ্রেপ্তার বা ধ্বংসের খবর পাওয়ার জন্য দেশবাসী উদগ্রীব। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও আশ্বস্ত করে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি, এভাবেই জঙ্গিবাদ একটি ক্ষয়িষ্ণু বলয়ে আটকে যাবে। লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়