জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সম্পর্কিত আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পেঁৗছে যাবার ফলে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার তাদের উন্নত জাতের ঘাস চাষের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ, গাভীর খামার ও হাঁস মুরগির খামার স্থাপনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান ছাড়াও বেকার যুবক, গৃহিণী ও কৃষকরা উন্নত জাতের ঘাস চাষকে তারা বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে।
উপজেলার বাহাদুরপুর এবং বড়গোপিনাথপুর গ্রামের অন্তত ৬০ জন মহিলা পুরুষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষের সঙ্গে জড়িত। বাহাদুরপুর গ্রামের ম-ল ও দক্ষিণ পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পীরগঞ্জের ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রডাক্টিভিটি প্রকল্পের আওতায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে তারা উন্নত জাতের ঘাস চাষের ওপর প্রশিক্ষণ লাভ করে। প্রথমে নিজেদের গবাদি প্রাণীর চাহিদা মেটাতে চাষাবাদ শুরু করলেও এখন তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে। তাদের এ সফলতা দেখার জন্য সুদূর আমেরিকা থেকে আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি ও ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা তাদের গ্রামে এসেছেন। বর্তমানে পীরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৩০০ একর জমিতে নেপিয়ারের ঘাস চাষাবাদ করে কৃষকরা তাদের গো- খাদ্য সংকট দূর করছে। অনেক জমিতেই নেপিয়ার ঘাস এখন ক্ষেতের বেড়া হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বিকেল হলেই দেখা যায় লোকজন মোটর সাইকেলের পেছনে, রিকশা, ভ্যান ও হাতে করে ঘাস কিনে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। যারা এখনও ঘাস চাষ শুরু করেনি, প্রতিদিন ঘাস ক্রয় তাদের একটি আবশ্যিক পণ্য ক্রয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, উন্নত জাতের ঘাস খাওয়ানোর ফলে গাভীর মাংস ও দুধের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি উৎপাদন খরচও কম হয় এবং গবাদি প্রাণীর রোগ ব্যাধির প্রকোপ কম দেখা দেয়। সবুজ ঘাস খাওয়ানোর ফলে গবাদি প্রাণি যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তেমনি ভাবে পশুর মালিকও আত্মতুষ্টি লাভ করেন ।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাছুদার রহমান জানান, বর্তমানে পীরগঞ্জ উপজেলায় ৭৬৫টি দুধের খামার ছাড়াও গরু মোটাতাজাকরণে ১ হাজার খামার রয়েছে। এসব খামারের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ৫ হাজার ৭০০ জন কৃষক ৩০০ একর জমিতে উন্নত জাতের ঘাস চাষ করছে। উপজেলার ১০টি জায়গায় স্থায়ী ঘাসের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ২শ’ জনের অধিক কৃষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন ও বিপনণ করে ঘাস চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ৫-৬ কেজি ওজনের একটি ঘাসের অাঁটি ১০ টাকা এবং একটি ঘাসের মূল .৭০ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি শতক জায়গায় প্রতি কাটিং এ ২৫০ কেজি ঘাস পাওয়া যায়। ঘাস লাগনোর দুই মাস পর প্রথম কাটিং এবং তারপর প্রতি এক মাস পর পর বৎসরে ৭-৮টি কাটিং দেয়া সম্ভব। বর্তমানে বছরে ১৮ হাজার টনের অধিক উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন হচ্ছে। উন্নত জাতের ঘাস খাওয়ানোর ফলে পশুর উৎপাদন ৫১% হারে বৃদ্ধি পায়। ঘাসের ক্ষেতকে আমরা দুধের ক্ষেত হিসাবে আখ্যায়িত করছি বলে তিনি জানান।
সামনে বর্ষা মৌসুম। এ সময় দেশের নিম্নভূমিগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। এসব অঞ্চলের গরু-মহিষের জন্য ঘাস তো দূরের কথা, কয়েক মুঠো খড় জোটানোও কঠিন। এ সময় অভাবের তাড়নায় অনেকে গরু-মহিষ কম দামে বিক্রি করে দেন। অনেকের গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া খাদ্যাভাবে দুর্বল হয়ে যায়।
বর্ষা মৌসুমে বাড়ির পাশের জমিতে ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পতিত জমিতে পানি ও আগাছা বেশি হয়ে থাকে। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই এরকম লাখ লাখ একর পতিত জমি সারা বছরই খালি পড়ে থাকে। একটু সচেতন হলেই আমরা এ জমিগুলো কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারি। বর্ষা মৌসুমসহ সারা বছরই এ জমিগুলোতে নেপিয়ার জাতীয় ঘাস চাষ করে গো-সম্পদের প্রসার ঘটানো যায়। নেপিয়ার ঘাস পরিত্যক্ত জায়গায় ভালো জন্মে। লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। দুই সপ্তাহ অন্তর ঘাস কাটা যায়। নেপিয়ার ঘাস চাষ খুব সহজ এবং ব্যয়ও কম। গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এ ঘাস খুব পছন্দ করে। তাই এরা সহজেই বেড়ে ওঠে।
চাষ পদ্ধতি : সএ ঘাস চাষের জন্য জমিতে চার থেকে পাঁচটি চাষ দিতে হয় এবং মই দিয়ে আগাছামুক্ত করার পর রোপণ করতে হয়।
ঘাস লাগানো : সারা বর্ষা মৌসুমেই এ ঘাস লাগানো যায়। তবে বর্ষার শুরুতেই রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে রোপণ করা হলে প্রথম বছরই তিন থেকে চার বার ঘাস কাটা যেতে পারে। এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব দুই থেকে তিন ফুট এবং এক চারা থেকে অন্য চারার দূরত্ব দেড় ফুট হবে। মাটিতে রস না থাকলে চারা লাগানোর পর পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত প্রতি একর জমি রোপণের জন্য সাত থেকে আট হাজার চারা বা কাটিংয়ের প্রয়োজন হয়।
নেপিয়র ঘাসের উপযোগী জলবায়ু ও ভূমি : এ ঘাস সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। তবে বেলে দোঅাঁশ মাটিতে এর ফলন সবচেয়ে বেশি। এ ঘাসের জন্য উঁচু জমি ভালো। বন্যা প্রস্তাবিত জমি এ ঘাস চাষের জন্য অনুপযুক্ত। বাংলাদেশের আবহাওয়া নেপিয়ার ঘাস চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত
সার প্রয়োগ ও পানি সেচ : ভালো ফলন ও গাছের বৃদ্ধির জন্য সার এবং পানির প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে পানি সেচের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্য সময়ে সাধারণত পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
জমি প্রস্তুতের সময় : ১.৫০ থেকে ২.০০ টন গোবর প্রতি একরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ ইত্যাদি সার ব্যবহার করা হয়।
ঘাসের ব্যবহার ও ফলন : নেপিয়ার ঘাস কেটে খাওয়ানো সবচেয়ে ভালো। এতে অপচয় কম হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ফলন বেড়ে যায়। ঘাস লাগানোর তিন মাস পর কাটার উপযোগী হয়। তিন সপ্তাহ পরপর ঘাস কাটা যায়।
প্রথম বছর ফলন কিছুটা কম হয় কিন্তু পরবর্তী দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত ফলন বেড়ে যায়। বছরে সাধারণত আট থেকে ১০ বার ঘাস কাটা যায় এবং গড়ে প্রতি একরে বছরে ৩০ থেকে ৪০ টন কাঁচা ঘাস পাওয়া সম্ভব। কাঁচা ঘাসের গোড়ার সঙ্গে রেখে কাটা পরবর্তী ফলনের জন্য ভালো। জমি থেকে কেটে এ ঘাস সরাসরি গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে।