সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের ১৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের মেসার্স জেটিটি-এসবিএসএস-সিসিসিই কনসোর্টিয়ামের অনুকূলে ওই বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ৮০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আসায় খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে পিডিবি সূত্র জানায়। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সন্দ্বীপের মানুষ প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রিডের আওতায় বিদ্যুৎ সুবিধা পাবেন। এর ফলে সেখানকার তিন লাখ বাসিন্দার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। এছাড়া শুধু বিদ্যুৎ সুবিধার অভাবে পিছিয়ে পড়া সমুদ্রবেষ্টিত এই জনপদে আমূল পরিবর্তন আসবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, ক্রয় প্রস্তাবটি গত ৩ আগস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন হলেও গতকাল সোমবার এ সংক্রান্ত চিঠি পিডিবি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব এ টি এম মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত চিঠিতে সরকারি সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি মাসের শেষ কর্মদিবসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমেই প্রকল্পের আসল কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে দাবি করেন পিডিবি কর্মকর্তারা। পিডিবির একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, যদিও মন্ত্রিসভা বৈঠকে অত্যধিক ব্যয়ের অজুহাতে প্রকল্পটি বাতিলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। পরে সন্দ্বীপে একটি ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুেকন্দ্র বসানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বিবেচনায় সাবমেরিন প্রকল্পটির ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হল। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ চট্টগ্রামে প্রায় পাঁচ লাখ নতুন গ্রাহক সৃষ্টি হবে। এই চাহিদার কথা বিবেচনা করে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প’। এর আওতায় ২৩১০ কিলোমিটার নতুন বিতরণ লাইন বসানো হবে। ওই প্রকল্পের মধ্যেই সন্দ্বীপে সাবমেরিন লাইন বসানোর প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত আছে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে ১৬ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ দিয়ে সন্দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত করা হবে। সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন এবং সাব-স্টেশন স্থাপনের দরপত্রে এক কোটি ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৬৬ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ২৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯১৩ টাকাসহ মোট ১৪৪ কোটি ৫০ লাখ ১৬ হাজার ৮০৬ টাকা (মার্কিন ডলার ৭৯ টাকা দরে) দরপ্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় চীনের মেসার্স জেটিটি-এসবিএসএস-সিসিসিই কনসোর্টিয়াম। পিডিবিসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুতে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সিঙ্গেল লাইন সাবমেরিন ক্যাবল বসানোর কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নির্ভরযোগ্যতা এবং দুর্ঘটনা এড়াতে এই লাইন ডাবল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাতে কোনো কারণে একটি লাইনে ত্রুটি দেখা দিলে অন্য লাইন সচল থাকে। এ কারণে প্রাথমিক হিসাবে সাবমেরিন প্রকল্প ব্যয় ৮০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে এই ব্যয় প্রায় ১৪৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুল মোত্তালিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুমোদন পাওয়ার পর পরই আমরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তিতে যাব। এর পরেই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শুরু হবে। আশা করছি এই শুকনো মৌসুমেই আমরা কাজ শুরু করতে পারব।’ তিনি জানান, বাড়বকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপের যে চ্যানেলে সাবমেরিন ক্যাবল বসানোর কাজ হবে সমুদ্রের সেই অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই একটু উত্তাল থাকে। যে কারণে শুধু শুকনো মৌসুমে কাজ করা সম্ভব হবে। এর পরও প্রকল্পের নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যেই শেষ করা হবে। সন্দ্বীপে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সন্দ্বীপ পৌরসভার মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ হচ্ছে যেকোনো উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। সন্দ্বীপ উপজেলার মানুষ জন্মলগ্ন থেকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ কারণে সকল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই জনপদ অন্য উপজেলা থেকে অবহেলিত। অথচ দ্বীপটির প্রবাসীরাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ জোগান দেয়।’ মেয়র বলেন, ‘শুধু জাতীয় গ্রিডের আওতায় এলে সন্দ্বীপে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠবে। চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ার কারণে পর্যটনভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার খুব ভালো সম্ভাবনা তৈরি হবে।’