একুশে আগস্ট ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শেখ হাসিনা

নিতাই চন্দ্র রায় : মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি. গোপালপুর, নাটোর।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত ও বিভীষিকাময় দিন। এ দিনে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৪০০ লোক আহত হয়। ওই নারকীয় হামলায় নিহতদের মধ্যে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী মিসেস আইভী রহমান ছিলেন অন্যতম।

সারা দেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল পাঁচটায়। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন তিনি । বঙ্গবন্ধু কন্যা মঞ্চ থেকে যখন নেমে আসতে থাকেন, ঠিক তখনই শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনেটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১৩টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলে ১২ জন এবং হাসপাতালে আরো ১২ জন নিহত হন। এ ঘটনায় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়, যার বিচার এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি।

গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে নিহত মানুষের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ, শত শত আহত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ, দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোয়াশাচ্ছন্ন ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করে। লাশের মিছিল ও স্বজনদের আজাহারি এবং আহতদের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকার পরিবেশ। ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে এক মানববর্ম রচনা করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের এক জনসভায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে একইভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্পিøন্টার শরীরে থাকার কারণে তাঁর অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ব্যাংককে মারা যান। অপরদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেড আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ইতিহাসের বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলায় উল্লেখযোগ্য নিহতরা হলেন- আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল মাহবুবুর রশীদ (অব.), রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা) সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী, রতন শিকদার, মো. হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, আবদুল কদ্দুছ পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসির উদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কালাম আজাদ, আবুল হাশেম, মমিন আলী, শামছুদ্দিন, ইসাহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতনামা আরো দুজন। মারাত্মক আহতরা হলেন- শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুর করিম, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ, অধ্যাপক আবু সাঈদ, ওবায়দুল কাদের, এডভোকেট সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, নাসিমা ফেরদৌস, মামুন মল্লিক প্রমুখ।

দীর্ঘ ১২ বছর যাবৎ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতকর্মী শত শত বিষাক্ত স্পিøন্টার দেহে বহন করে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। আহতদের মধ্যে রাজধানী ঢকার ৬৯নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক রাশিদা আক্তার ওরফে রুমা বলেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। গত ১২ বছরে একটি রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্পিøন্টার। ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। পায়ের ঘা কিছুতেই শুকাচ্ছে না। একটা কান আগেই গেছে, একটা কিডনিও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মনে হয় সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো। এ যন্ত্রণা আর সইতে হতো না।’ রাশিদার মতোই অসহ্য যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছেন নাজমুল হাসান, ইয়াসমিন হোসেন, লুৎফুন্নেছা, সিরাজুল ইসলাম, নিহার রঞ্জন কর, নাসিমা ফেরদৌস, মাহবুবা পারভিনসহ আরো অনেকে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পরিকল্পায়, যারা সমর্থন দিয়েছিল তাদের উত্তরসূরিরাই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করেছিল। মুফতি হানান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে- কারা কারা এই নৃশংস হত্যার পরিকল্পার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে দিনের গ্রেনেডের হিংস্র আক্রমণ, দানবীয় সন্ত্রাস, মানবতাবিরোধী জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের আলোকচিত্র অবলোকন করে সারা পৃথিবীর বিবেক হয়ে গিয়েছিল আতঙ্কিত, স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের হোতাদের জানায় তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার। এ বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ইকবাল সোবাহান চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে খুন করে এ দেশ পাকিস্তানি কায়দায় চালানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ২১ আগস্ট হত্যার চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে দিন বঙ্গবন্ধু কন্যা বেঁচে গেছেন। ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। ওরা নানা কায়দায় দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

সম্প্রতি হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনা এবং সারা দেশে মুক্তমনা ব্লুগার, হিন্দু পুরোহিত, মসজিদের ইমাম, খ্রিস্টান ধর্ম যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষুক, প্রগতিশীল লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লালন ভক্তদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের ঘটনার ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। সারা দেশের মানুষ মিছিল, মিটিং ও মানববন্ধনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ, ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাতে প্রমাণিত হয়- বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকে ঘৃণা করে, তারা চান দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। বুকের রক্ত দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করেছেন। নবাব সিরাজ-উদ দৌলাকে হত্যার পর তাঁর চরিত্র নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু সেই অপপ্রচার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মহান নেতার চরিত্র নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়, অপপ্রচারে মানুষ কান দেয়নি। আজ বঙ্গবন্ধু তাঁর আগের আসনে ফিরে এসেছেন। তাঁর আদর্শ, চিন্তা, চেতনা, দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জীবন দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুসরণের অনন্ত উৎস। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও কিংবদন্তির নায়ক। মানুষের হৃদয়ে তিনি ছিলেন, আছেন ও ভবিষ্যতে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে ১০ মাসের কারাবাসের কাহিনী নিয়ে শিমুল সরকারের পরিচালনায় নির্মাণ হতে চলেছে সাদা ‘পায়রা’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও সাহসী উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই তিনি রাতদিন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এভাবেই কাজ করে যাবেন- এছাড়া তাঁর আর কোনো আকাক্সক্ষা নেই। তাই তিনি ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের গরিব, দুঃখী ও মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বদ্ধপরিকর।

১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলে আসছে। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াসে শেখ হাসিনাকে ২১ আগস্ট হত্যার চেষ্টা করা হয়। সে দিনে পৈশাচিক হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন গণতন্ত্রের মানস কন্যা ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছিলে স্বাধীনতাকামী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবনা ও ভরসার প্রতীক। এ জন্যই শেখ হাসিনার প্রতি ঘাতকদের এত আক্রোশ। এত প্রতিহিংসা। এত জিঘাংসা। ঘাতকদের চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূণর্তা অর্জন করেছে। শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নে অনেক উন্নয়নশীল দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ বছরে। বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর আর পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ ডলার। বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অষ্টম সুখী দেশ। সব সূচকে বাংলাদেশের এই যে অভাবনীয় উন্নয়ন- এটা সম্ভব হয়েছে জাতির জনকের আদর্শ ও শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অর্জন আগে কখনো হয়নি। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকেও ছাড়িয়ে যাবে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে মধ্যে হবে একটি পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নত দেশ।