আট লেন ও পায়রা বন্দর

দেশে প্রথম আট লেন হাইওয়ে চালু হলো, আবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন একটা বন্দরও চালু হলো। এই ঘটনা নিয়ে একদিন মাত্র দেশের মিডিয়া, তাও বিশেষ করে কয়েকটি পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করে। এর পরে এ নিয়ে ওইভাবে কোন আলোচনা হতে শুনিনি। কেন হলো না ঠিক বুঝতে পারলাম না। এই দুটি ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গত সাত বছর ধরে ক্রমান্বয়ে একটি ধারাবাহিক অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে তারই অনেক বড় সূচক। বাংলাদেশ যখন দশ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে, খুব শীঘ্র ২০ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতার টার্গেট ছোঁবে- এ সময়ে এই আট লেন ও পায়রা বন্দর উন্নয়নের ধারাবাহিকতার আরেকটি অধ্যায়ে প্রবেশ।

বাংলাদেশ যখনই সক্ষমতার সমমানের বিদ্যুত উৎপাদন করবে তখন ঠিকই এই বিদ্যুত দিয়ে মানুষ শুধু ঘরে ঘরে বাতি জ্বালিয়ে গৃহস্থালি কাজ করবে না, এর অন্তত ৬০ ভাগ বিদ্যুত ব্যবহৃত হবে শিল্প ও কৃষি-শিল্পে। বর্তমানে কৃষি যেখানে চলে গেছে এটাকেও শিল্পের একটি অংশ বলতে হয়। সেখানেও বিদ্যুত ছাড়া একটি মুহূর্ত চিন্তা করা যায় না। চিন্তা করা যায় না শিল্পায়িত মুরগি, গরু, মাছ প্রভৃতি পণ্য বিদ্যুত ছাড়া উৎপাদন হবে। কারণ এগুলোকে কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্রাণী থেকে পণ্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে কৃষি-শিল্পায়নের ফলে।

বাংলাদেশ যে সময়ে একের পর এক ইপিজেড করতে যাচ্ছে। অনুমতি দিচ্ছে প্রাইভেট ইপিজেডের। যদিও এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, প্রাইভেট ইপিজেড এখন পর্যন্ত যা হয়েছে সেগুলো সরকারই জমি দিয়েছে। এখন সরকারের চিন্তা করা উচিত ব্যক্তি পর্যায়ে জমি যোগাড় করে কেউ প্রাইভেট ইপিজেড গড়ে তুলুক এবং সেখানে তাদের অন্য কী কী সুবিধা দিতে পারে সরকার- যাতে সেগুলো খুব দ্রুত গড়ে উঠবে। সাত বছরের এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, শত প্রতিকূলতার মাঝেও এই সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছে দ্রুত গতিতে। আমাদের দেশে যেহেতু পজিটিভ জার্নালিজম হয় না, আমরা এখনও ঔপনিবেশিক আমলের জার্নালিজমে পড়ে আছি অর্থাৎ জার্নালিজমের ক্ষেত্রে আমরা প্রায় ষাট থেকে সত্তর বছর পিছিয়ে আছি বলে আমার মনে হয়। ভুল হলে সিনিয়র ও বিজ্ঞ জার্নালিস্টরা আমাকে মাফ করবেন। কারণ, মানুষ মাত্রই চিন্তার পার্থক্য থাকে। সেই স্বাধীনতা থেকে আমি এ মন্তব্য করলাম। তবে এটা সত্য আমরা দেশের গত সাত বছরের উন্নয়নকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। যা হোক, এ প্রসঙ্গ এখানে নয়। বরং সাত বছরের এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সরকার যে আট লেন ও পায়রা বন্দরে প্রবেশ করল এটা দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সূচনা।

অর্থনীতিবিদরা অনেক ভাল জানেন, রাস্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কি নিগূঢ় সম্পর্ক। একটা কথাই আছে রোড আর্নস মানি। কীভাবে এই অর্থ আয় করে তা কম-বেশি সকলে আমরা বুঝি, এর জন্য অর্থনীতির কোন বই না পড়া থাকলেও খুব ক্ষতি হয় না। এখন এই রাস্তার পরিমাপটা অর্থনীতির ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাল রেখে এগুতে হয়, কোন কোন দেশ যেমন চীন এখন তাদের ভবিষ্যত অর্থনীতিকে সামনে রেখে রাস্তা তৈরি করে রাখছে। আমেরিকাও এ কাজ অনেক আগেই করেছিল। বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে পঁয়তাল্লিশ বছর পার হলেও বঙ্গবন্ধুর তিন বছরে নেয়া হয়েছিল প্রায় ৫০ বছর সামনে রেখে একটি পরিকল্পনা। যা বঙ্গবন্ধুর ওই সময়ের পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়। তারপরে বাংলাদেশ মিনি পাকিস্তান হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে। এর পরে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নের একটা চেষ্টা ছিল। অনেক কাজও সে সময়ে হয়েছিল। বিদ্যুত হয়েছিল যা ছিল তার ওপরে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের মতো। কিন্তু গত সাত বছরে পরিণত শেখ হাসিনার যে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব আমরা দেখছি তা একটি বিস্ময়। যেমন দ্রুত বিদ্যুত আইন। উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে এ যে কত বড় কাজ দিয়েছে তা এখান থেকে শত বছর পরে যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাস লিখবেন তারা এর মূল্যায়ন করবেন। তেমনি বিদ্যুত সক্ষমতা দশ হাজার মেগাওয়াট পার হওয়ার পরেই এই আট লেনের কেবল সূচনা এই ধারাবাহিকতা যদি ধরে রাখতে পারে দেশ তাহলে উৎপাদন ও পরিবহন তখন সমান তালে এসে যাবে। উন্নয়নের জন্য আমাদের এখন বিশ্বের সঙ্গে রাস্তা সংযোগে সংযুক্ত হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। তাই সে সময়ে একটি আট লেন নয়, আরও দশ বিশটি আট লেন প্রয়োজনের তাগিদ থেকে তৈরি হবে।

একটি বিষয় এখানে কাকতালীয় হলেও বর্তমান অর্থনীতির একটি চমৎকার দিক উপলব্ধি বলতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঠা-া লড়াইয়ে দুই ভাগে ভাগ পৃথিবীতে অর্থনীতির একটি দিক লক্ষ্য করা গিয়েছিল অর্থনীতি অতীতে যে সমুদ্র পথ নির্ভর ছিল সেখান থেকে অনেক বেশি রাস্তা নির্ভর হয়ে ওঠে। কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের পরে অর্থনীতি তার অতীতের একটি দিককে আরও জোরের সঙ্গে যোগ করে তা হলো সমুদ্রবন্দর নির্ভর অর্থনীতির বিশাল দিক। এই দিকটি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ছিল না তা নয়, তবে অনেকখানি ভাগ হয়ে গিয়েছিল পাশাপাশি রাস্তার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল বেশি। গ্লোবালাইজেশনের পরে এখন মেরিটাইম অর্থনীতি ও রাস্তা সংযুক্ত অর্থনীতি সমানতালে এগুচ্ছে। এ জন্য কাকতালীয় হলেও একই দিনে আট লেন ও পায়রা বন্দর উদ্বোধনের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশ যে সমান তালে পা রাখতে চায় তার প্রমাণ দিয়েছে।

বর্তমান যে আট লেনটি হয়েছে তা খুব দীর্ঘ নয়, ভবিষ্যতে এমন আট লেন আরও বাংলাদেশকে তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ও পদ্মা সেতু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কারণ পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ার পরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল যে শিল্প ও কৃষি-শিল্পায়নে যাবে সেখানে এই বন্দর অনেক বেশি কর্মমুখর বন্দর হবে। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে এখনও অনেক চর এলাকা আছে এগুলো প্রাইভেট ইকোনমি জোন হিসেবে তখন আত্মপ্রকাশ করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে অবশ্যই চীনের মেরিটাইম সিল্ক রুট ব্যবহার করতে হবে নিজস্ব অর্থনীতির স্বার্থে। কারণ বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে এখন দেখা যাচ্ছে, বড় মাপের শিল্পায়িত পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রোড বা আকাশ পথের থেকে এখনও অনেক বেশি উপযোগী মেরিটাইম রুট।

বাংলাদেশ যে গত সাত বছরে এ সব বিবেচনায় রেখে এগুচ্ছে তা কিন্তু এর অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো দেখলে বোঝা যায়, এখন দরকার এগুলো এগিয়ে নেয়া। এগিয়ে নেয়ার জন্য সব থেকে বড় দরকার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। যেদিন সরকারপ্রধান এই আট লেন ও পায়রা বন্দর উদ্বোধন করলেন ওই দিন একজন চাইনিজ প্রকাটিক্যাল ইকোনমিস্ট বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যায় গল্প করছিলাম। তিনি বাসার রুমে পড়ে থাকা একটি ইংরেজী দৈনিকের প্রথম পাতায় পায়রা বন্দরের ছবি দেখে এ প্রসঙ্গটি টেনে আনেন। কিন্তু অর্থনীতির কথার থেকে তার কথা রাজনীতির দিকে চলে যায় বেশি। তার মতে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য সব থেকে বড় দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। একটু ইচ্ছে করেই ধারাবাহিকতার ধরনটি তার কাছে জানতে চাই, এ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে তার মতামত জানালেন, আগামী দুই বছর ও পরবর্তী পাঁচ বছর এ দেশে শেখ হাসিনা পরিচালিত সরকার দরকার। কারণ এই সময়টা অর্থনীতি বড় একটা টার্ন নেবে। এ সময়ে অনঅভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে বা অর্থনীতি ফ্রেন্ডলি নয় এমন কোন নেতার হাতে দেশের নেতৃত্ব গেলে বাংলাদেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যর্থ হয়ে যাবে। তার মতে, এই সাত বছর পরে যে কোন সরকার আসতে পারে তবে তাকে অবশ্যই এই অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা ফ্রেন্ডলি হতে হবে।