ফারজানার স্বপ্নের ‘এসআরসি’

ছোটবেলা থেকেই বৈষম্যের শিকার শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন ফারজানা। অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। তবে দমবার পাত্র নন তিনি। ২০০০ সালে মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। সেই থেকে এক যুগ প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ততদিনে তার ভেতরের লালিত স্বপ্নটিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বামী মনিরুল আহসান স্ত্রীর এই অব্যক্ত কথা বুঝতে পেরে নিজেই কিছু করার কথা জানান। ফারজানার স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বামীর উৎসাহ। ফলে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রশিক্ষণভিত্তিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ‘সোসাইটি ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব অটিস্টিক চিলড্রেন (এসআরসি)’। এখন আলো ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। তিনি মনে করেন, প্রত্যাশার জয়েই তার পূর্ণতা আসবে নিশ্চয়।

বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থী ২৫ জন। তাদের মধ্যে দু’জন আবাসিক। বাকি ২৩ জনের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়ছে ৩ শিশু। আরও কয়েকজন স্বল্প-খরচে পড়ছে।

আবাসিক শিশুর মধ্যে মেলিসা চৌধুরী ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারায়। একমাত্র ভাই দেখভাল করলেও মেলিসা মেয়ে হওয়ায় প্রায়ই তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই যে, মেলিসার দেখভাল করবে। তাই নিরুপায় ভাইটি শরণাপন্ন হন ফারজানার ‘এসআরসি’তে।

মেলিসার শিক্ষক নাবিলা আক্তার জানান, ‘প্রথম দিকে তাকে সামলানো কঠিন ছিল। এখন তার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে মাসের পনের দিন একদমই কারও সঙ্গে কথা বলে না। বাকি দিনগুলো সবার সঙ্গেই কথা বলা, নাচ করা ও আঁকাআঁকি করে কাটায় সে।’ এসআরসিতে শিক্ষা ও থেরাপির জন্য শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী

রয়েছেন ১৫ জন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলে এর কার্যক্রম।

ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে ফারজানা আবেদীন টুম্পা বলেন, বাধাগ্রস্ত শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আরও কিছু শাখা খোলার ইচ্ছে আছে। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের কাউন্সিলিং-এর জন্য ‘কাউন্সিলিং সেন্টার’ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

রাজধানীর লালমাটিয়ার জি ব্লকের ১/৩ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির তিন তলা জুড়ে গড়ে উঠেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম তলায় অফিস রুমসহ থেরাপি ও ক্লাস রুম। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ক্লাস রুম, ভোকেশনাল রুম ও ডাইনিং রুম। তিন তলায় আবাসিক ব্যবস্থা। শিশুদের সুষ্ঠু ও মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ক্লাস রুমেই শিশুদের জন্য রয়েছে খেলনা। এখানকার শিশুরা আর পাঁচজন স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়। তাদের অনেকে কথা বলতে পারে না; কেউবা মানসিক বা দৈহিক গড়নে অস্বাভাবিক। তাদের শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধির প্রসার ও সৃজনশীল করে গড়ে তুলতেই প্রতিষ্ঠানটির আপ্রাণ চেষ্টা।

নয় বছরের শিশু ‘আফরিন’। এখন গুটি-গুটি পায়ে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়, আগে যেমনটা ভাবাই যেত না। এখন অনেক কিছুই বোঝে সে, সুন্দর ছবিও আঁকে। আফরিনের মা সালমা বেগম বলেন, ‘রেট সিনড্রমে আক্রান্ত সে। জন্মের ৬ মাস পরেই সন্তানের অস্বাভাবিক বিকাশ লক্ষ্য করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে কোনো ইতিবাচক ফল না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙেও পড়েন। এই স্কুলে ভর্তি করানোর পর এখন মেয়ের আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে কিছু খেতে চাইত না। এখন সে নিজেই খেতে পারে।’

এসআরসির কর্ণধার ফারজানা আবেদীন টুম্পা জানান, এইচএসসি পরীক্ষার পরেই ১৯৯২ সালে তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর কোলজুড়ে আসে এক ছেলে সন্তান। এরই মাঝে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে ‘চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে সোয়াক-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। শুধু প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি ভালোবাসা আর তাদের মায়েদের দুশ্চিন্তার বিষয়টি ভেবেই তিনি সোয়াকে সম্পৃক্ত হন মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে। নিজেকে সমৃদ্ধির জন্য পুনরায় বেসরকারিভাবে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্সও করেছেন। এক সময় নিজে কিছু করার উপলব্ধি করেন। স্বামীর উৎসাহ পেয়েই প্রতিষ্ঠা করেন এসআরসি।

ফারজানা সমকালকে বলেন, ‘সোয়াক-এ সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই পরিবারের প্রতি ততটা মনোযোগ দিতে পারিনি। সারাক্ষণ প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব_ তা নিয়ে ভাবতাম। প্রতিবন্ধী শিশুদের সময় দিতে গিয়ে নিজের সন্তানকেই সময় দিতে পারিনি। ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত স্কুলের কাজ করি। এমনকি অনেক মায়ের দুরবস্থার কথা শুনে আর্থিক ক্ষতি জেনেও, আবাসিক ব্যবস্থা ও ডে কেয়ার সেন্টার চালু করেছি। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ও স্বামীর আর্থিক সহায়তায় এতটা পথ আসতে পেরেছি।’

প্রতিষ্ঠানটির শিশু আর শিক্ষক এই দুইয়েই সমান সমান। দুই শিফটে ক্লাস হওয়ায় প্রতিটি শিশুর জন্য একজন করে কাজ করেন। সেখানে ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, মানসিক প্রতিবন্ধী সামিউলকে সামলাতে পেছন পেছন ছুটছেন শিক্ষক সাঈদ আহমেদ। যদিও ডাক দিতেই কিছুক্ষণের জন্য সামিউল থেমে যায়। যা এক বছর আগেও এমনটি সম্ভব ছিল না।

সাঈদ বলেন, এক বছরে যেসব শিশু এখানে থেরাপি গ্রহণ করছে, তাদের মধ্যে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে এ স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে শিশুদের সঙ্গের শিক্ষক পরিবর্তন করা হয়। এক এক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি মাসে দুটি করে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় একেকটি শিশুর উন্নতি ও অবনতির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির আরেক শিক্ষক জেসমিন খাতুন শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশে কাজ করছেন। তাদের দিয়ে ছবি আঁকানো, গান গাওয়াসহ সাংস্কৃতিক চর্চা করান তিনি। জেসমিন বলেন, শিশুদের সুস্থ করে গড়ে তুলতে সমন্বয়মুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি। তারা যা চায়, তা করার চেষ্টা করি; বোঝানোর চেষ্টা করি। পরে অটিজম আক্রান্তদের প্রশিক্ষণ, দিকনির্দেশনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ চলে। এ ছাড়া নিয়মিত থেরাপি, যোগব্যায়ামও করানো হয়।

শারীরিক সমস্যা, মানসিক ও বুদ্ধি বিকাশজনিত সমস্যা, ইন্দ্রিয় ও ধ্বনিগত সমস্যা, আবেগ ও আচরণগত সমস্যা অর্থাৎ সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যার পর্যাবেক্ষণ করা হয় শিশুদের। এ ছাড়া মানসিক প্রতিবন্ধী নির্ধারণে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পর্যবেক্ষণ_ যেমন বুদ্ধিমত্তার মান নির্ণয়, সামাজিক আচরণ ও বয়সের সঙ্গে মানসিক উন্নয়ন ও ক্রিয়াকলাপ। সেই পর্যবেক্ষণের ফল অনুসারে শিক্ষকরা শিশুদের জন্য কাজ করে থাকেন।

এসআরসি শিশুকে কথা বলা শেখানো, অনুশীলনের মাধ্যমে দুর্বল মাংসপেশিকে সবল করে শিশুকে পেন্সিল বা ছোট ছোট জিনিস ভালোভাবে ধরতে শেখানো, শিশুর সৃজনশীল ক্ষমতাকে প্রকাশ, তার দৃষ্টিগত, আচার-আচরণগত ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজে নিজে করতে শেখানো; যেমন_ কাপড় পরা, দাঁত মাজা, নিজে নিজে খাওয়া, শৌচাগারে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিশুকে উৎসাহিত ও পারদর্শী করে তোলার প্রতি প্রচেষ্টা থাকে।

এসআরসির প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা আবেদীন টুম্পা মনে করেন, এ বাধাগ্রস্ত শিশুরাও ক্রমেই দক্ষ ও যোগ্য জনবল হিসেবে সুস্থ জীবনের অধিকারী হবে। তার মতো আরও অনেকেই এগিয়ে আসবে এসব শিশুর সেবার উদ্দেশ্যে।