এক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখন কেবল বাংলাদেশের মানুষের, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো বা দেশটির শত্রু মিত্রদের কাছেই পরিচিত নন। তিনি এখন সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অসাধারণভাবে পরিচিত। আমি তাকে কেবল বিশ্বের ক্ষমতাধর মানুষদের তালিকার মানুষ হিসেবে দেখি না, তাকে দেখি বাংলার স্বর্ণকন্যা হিসেবে। সারা দুনিয়ার জন্য তিনি কি করেছেন তার চাইতে জরুরি হচ্ছে তিনি তার দেশের মানুষের জন্য কি করেছেন সেটা। তার কাজের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়াবাসীদের বাংলাদেশ থেকে শেখার কথা বলেছেন। তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল ইন্ডিয়া গড়তে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেছেন। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে এখন মহাকাব্য লেখা যায়। ইতিহাসের অমোঘ বিধান হিসেবে কেউ না কেউ সেই কাজটি করবেন কখনও। যদি এমন কোন একটি কাজ আমি করে যেতে পারতাম তবে খুব খুশি হতাম। বয়সে কুলাবে কিনা বা সময় করে ওঠতে পারবো কিনা সেটি নিশ্চিত নই বলে প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারবো না যে কাজটি আমি করেই যাব। তার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, সরকার পরিচালনা, দল চালানো, পরিবার ইত্যাদি নানা বিষয়ে বইয়ের পর বই লেখা যায়। আমি এই আলোচনায় খুব ছোট করে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে তার অসাধারণ অবদানের খুব খ-চিত্র একেবারেই ব্যক্তিগত প্রেক্ষিত থেকে লিখছি। ছোট এই রচনাটি জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৮ সালে। যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম ক্লাস করি সেদিনই কাঁদানে গ্যাস খেয়েছিলাম। এরপর আইয়ুব খানের পতন পর্যন্ত সময়টা কেমন কেটেছে সেটা ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বিষয়ে যারা ছোটখাটো খবর রাখেন তারা সবাই জানেন। আইয়ুববিরোধী সেই আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ভিতটিকে আরও শক্ত করে তোলে। আর এই আন্দোলনে শরিক আমরা সেই এক প্রজন্ম যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এজন্য রাজপথ আমাদের স্থায়ী বসবাসের জায়গা হয়ে যায়। তবে এমন নয় যে আমরা ক্লাসে একেবারেই ঢুকিনি। বিশেষ করে আমরা সেসব শিক্ষককে পেয়েছিলাম যাদের ক্লাস করার জন্য অন্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ক্লাসে চলে আসতেন। স্মরণ করুন প্রফেসর মুনির চৌধুরী, ডঃ আহমদ শরিফ, ডঃ নিলীমা ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বা আনোয়ার পাশাদের কথা। ভাবুন ডঃ রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আকরাম হোসেন, আহমদ কবির স্যারদের কথা। এমনকি ডঃ আনিসুজ্জমানও আমাদের পড়িয়েছেন। অন্যদিকে তোফায়েল আহমেদ, আসম রব, সাজাহান সিরাজ বা আব্দুল কুদ্দুস মাখন ছাত্রলীগের রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। পেছনে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি। সবার ওপরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।এজন্যই হয়তো রাজপথ কাঁপানো থেকে বটতলা-কলাভবনের দোতালা কাঁপানোর কোনটাতেই আমরা পেছনে ছিলাম না। বিশেষ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজপথ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়ায়ও মনযোগী হই। তবে লেখাপড়া গৌণ এবং রাজনীতিটা তখন মুখ্য হয়েই থাকে। বরং খুব সহজেই একথা বলা যায় যে ৬৮-৬৯-৭০ সালটা আমাদের পুরোই একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। তখন ছাত্রলীগ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সৈনিক গড়ে তুলতে সমর্থকদের প্রস্তুত করে তুলে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রস্তুত হয়। এমন উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থাতেই ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক সম্মান শ্রেণীর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করা শুরু করি।১৯৬৮ সালের জুলাইতে অনার্সের ক্লাস শুরু করে ‘৬৯-এর আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে তখন আমরা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। চারদিক থেকে প্রস্তুতি চলছিল সত্তরের নির্বাচনের জন্য গ্রামের বাড়িতে অনেক কাজ করতে হবে। বাংলা বিভাগের ৬৮ সালের ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা নামক কেউ আমাদের ক্লাসে ছিলেন না। আমি বঙ্গবন্ধু পরিবারের বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ৬৭ সাল থেকে যখন ঢাকা কলেজে পড়ি। আমাদের এক বছর পরে ঢাকা কলেজে এসে পুরো কলেজটাকে ছাত্রলীগের দুর্গ বানিয়ে ছিলেন শেখ কামাল। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল শেখ কামালের। যে কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল সেই কলেজ হয়ে উঠেছিল ছাত্রলীগের দুর্গ। সেখানেই শেখ কামালের সঙ্গে রাজনীতি করি। মাঝখানে এক বছর বিরতির পর ‘৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আবার পরিচয়টা গাঢ় হয়। অবশ্য এই গাঢ়ত্বের জন্য শেখ কামালের রাজনীতির বাইরের বাড়তি গুণের কথা উল্লেখ করতে হবে। শেখ কামাল কেবল রাজনীতি পাগল ছিলেন না। তার রক্তের নেশা ছিল খেলাধুলা এবং নাটক। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, আমার লেখা এক নদী রক্ত নাটকে তিনি অভিনয় করেন। নটকটি ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই নাটকেই প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার ধারাবাহিক কাহিনী বিধৃত হয়। সেই ৫২ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টাতে বাঙালি জাতির লড়াইয়ের ইতিহাস ছিল সেই নাটকে। তবে আমরা বাংলা বিভাগের এই ব্যাচ তখনও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার খবরই রাখতাম না। তখন শুনেছি তিনি ইডেন কলেজের ভিপি নির্বাচন করে জিতেছিলেন।আমাদের বাংলা বিভাগের ব্যাচটির একটি প্রধান ধারা ছিল যে তাতে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল। তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সাধারণত ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন বা সমর্থন করতেন। তাদের ধারণা ছিল ভালো ছাত্র বা সুশীল ছাত্ররা ছাত্রলীগ করে না। ওরা ছাত্র ইউনিয়ন করে। সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন অনেক বেশি সম্পৃক্ত বলে মেয়েরা ধারণা করত। তাদের ধারণা ছিল ছাত্রলীগ করে গু-ারা। তবে ছাত্রলীগের কাউকে আমি কোনদিন গু-ামি করতে দেখিনি। তবে আমরা ছাত্র ইউনিয়নকে হারমোনিয়াম পার্টি বলতাম। খসরু-মন্টু-সেলিম তখন ছাত্রলীগের পেশিশক্তির প্রতীক। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের হুলিয়া ছিল। কিন্তু তারা ক্যাম্পাসে-বিশেষত জহুরুল হক হলে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন। ওদেরও কাউকে কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখিনি। বরং আমরা তাদের সকলেরই খুবই স্নেহভাজন ছিলাম। আমাদের ব্যাচের ছেলেরা বেশির ভাগই ছাত্রলীগ করতাম। আমি স্মরণ করতে পারি ছাত্রলীগের মাত্র দুজন সক্রিয় মহিলা কর্মী ছিলেন। একজন কুমিল্লার মমতাজ আপা, অন্যজন ঢাকার রোকেয়া। মমতাজ আপা মোটাসোটা ছিলেন। তার গায়ের রং ছিল কালো; আফ্রিকানদের মতো। রোকেয়ার মুখে ছিল বসন্তের দাগ। বোঝা যায় যে দুজনেই দেখাশোনায় তেমন সুন্দরী ছিলেন না। আমাদের সবার চাইতে বয়স্ক মনে করে আমরা মমতাজ বেগমকে আপা ডাকতাম। রোকেয়ার মুখশ্রী সুন্দর ছিল। তবে মুখে বসন্তের দাগ ছিল বলে কেউ তার পেছনে প্রেম করার জন্য ঘোরাঘুরি করত না। ফলে ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিল মানেই ছিলেন তারা দুজন। বিভাগে সামগ্রিকভাবে ছাত্রলীগের অবস্থান ভালো ছিল না। ফলে আমি একবার বিভাগীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করতে গিয়ে ৬ ভোটে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীর কাছে হেরে যাই। তেমন একটি সময়ে আমাদের সহপাঠিনী রোকেয়া একদিন দোতালার বাংলা বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন যে একজন মহিলা আসছেন যার চেহারাটা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলে যায়। তার হাসিভরা মুখ। গলায় সোনার চেন এবং হাতে আংটি। এমনিতেই হৈচৈ করা রোকেয়া এই দৃশ্য দেখে পুরো বিভাগ মাতিয়ে ফেললেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ঐ যে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। আমরা তখনও ভাবিনি যে তিনি কলা ভবনের দোতালাতেই আসছেন। তিনি দোতালায় উঠলেন এবং সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বললেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার এবং বাংলা বিভাগের ৬৮ ব্যাচের পরিচয় সেদিন থেকে। এরপর তিনি বিভাগের রাজনীতিতে সিরিয়াস হন এবং আমাদের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবুও আমরা বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের কাছে হেরে যাই। আমার কাছে তখন বিস্ময়কর মনে হতো যে শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের মতো ছাত্র ইউনিয়নের ঘাটিতে জিতেছিলেন কেমন করে। আমাদের ব্যাখ্যা ছিল যে তার বিজয়ের পেছনে ছাত্রলীগ কাজ করেনি-কাজ করেছে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা।আমাদের সহপাঠী-সহপাঠিনী যারা লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস তারা ৭০-এর আগস্ট থেকেই নিয়মিত তৃতীয় বর্ষের ক্লাস করতে থাকেন। আমরা যারা রাজপথ, জহুরুল হক হল, মধুর ক্যান্টিন এসব জায়গায় সময় কাটাতাম তারা মাঝে মধ্যে কলা ভবনের দোতালায় বাংলা বিভাগের বারান্দা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতাম। কোন কোন প্রিয় শিক্ষকের ক্লাসও করতাম। আমি স্মরণ করতে পারি না যে, শেখ হাসিনা কোন ক্লাসে বসে ক্লাস করছেন। তবে কলা ভবনের দোতালার বারান্দায় তাকে নিয়মিত দেখা যেত। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারি যে তিনি বিবাহিতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে তিনি বদরুন্নেসা ও ইডেন কলেজ মাতিয়ে এসেছেন। বাংলা বিভাগে আমাদের ব্যাচে তার যুক্ত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত হলাম। বিশেষ করে ছেলেদের ছাত্রলীগ করা আর মেয়েদের ছাত্রলীগ করার ভারসাম্যটা আমরা পাব তেমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল। তিনি আসার পরে আমাদের বিভাগে একটি নির্বাচন হয়। কিন্তু আমরা তাতেও হারি। আমাদের তখন ধারণা বাংলা বিভাগে ছাত্রলীগ কোনদিন জিতবে না। তবে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এটুকু স্মরণ করতে পারি যে বাংলা বিভাগের শেখ হাসিনা অতি সাধারণ বাঙালি ঘরের বধূ-কন্যা হিসেবে পুরো বিভাগের জন্য একটি দৃষ্টান্ত ছিলেন। ৭০ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু শেখ হাসিনা যে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে সেটি আমরা টেরই পেতাম না। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আসতেন। গায়ে গয়নার কোন চিহ্ন দেখতাম না। আর বিভাগজুড়ে আড্ডা দিতেন অতি সাধারণ ছাত্রীর মতো। আমাদের ব্যাচের জন্য শেখ হাসিনাকে সহপাঠিনী হিসেবে পওায়াটা কেবল অপ্রত্যাশিতই ছিল না গৌরবেরও ছিল। তবে একটি মজার বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন বা সরকার গঠন করেন তখন আমাদের ব্যাচের ছাত্রলীগ করতো তেমন কাউকে তার আশপাশে দেখা যায়নি। বরং আমাদের ব্যাচেরই যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতো বা আমাদের সিনিয়র যারা তার সঙ্গে পড়াশোনা করতেন তাদেরও বেশিরভাগ তৎকালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। এটি সম্ভবত এজন্য যে ব্যক্তিগত সম্পর্কটাকে তিনি অনেক মূল্য দিতেন।ঢাকা। ৭ আগস্ট, ২০১৬।[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]mustafajabbar@gmail.com