আলোকিত হয়ে উঠছে সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকা

জেলার অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলোতে দীর্ঘ ৬৮ বছরে ছিল না মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার। শিক্ষা, চিকিত্সা, বিদ্যুত্, স্যানিটেশন, রাস্তাঘাট, যানবাহনসহ নানা সমস্যার আবর্তে “না ঘরকা না ঘাটকা” হয়ে জীবনযাপন করে আসছিল জেলার ৩৬টি ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষ। অদ্ভুত জীবনযাপন ছিল ছিটমহলবাসীর। কোনো রাস্তা-ঘাট নেই এখানে। অধিকাংশই বৈদ্যুতিক আলো কি তা দেখেননি। সন্ধ্যার আগেই এরা ঘরে ফিরত। ছিটমহলের অধিকাংশই দেখেননি দ্রুতগামী মোটরগাড়ি, দালান-কোঠা এবং পরিচয় ঘটেনি আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে। বিশুদ্ধ পানির ছিল না কোনো ব্যবস্থা। পানিবাহিত রোগ আর পুষ্টিহীনতা এদের নিত্যসঙ্গী। ওরা যেন ছিল নিজভূমে পরবাসী। অবরুদ্ধ ছিটমহলের চারদিকে বাংলাদেশ মাঝখানে এক ভিন্ন দেশ। যে দেশে নেই কোনো রাজা, নেই কারো রাজত্ব।

১৯৪৭ সালে দেশ-ভাগের সময় ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি হয়। এরফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ভারতীয় এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষ হয়ে পড়ে অবরুদ্ধ। এই সমস্যা সমাধানে ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসলেও এই চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয়। এতে দীর্ঘ ৬৮ বছর দু’দেশের অভ্যন্তরের ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজ নিজ দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এরপরই পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের নাগরিকদের জীবনযাত্রায় অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে হয়েছে বিপুল পরিবর্তন। বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পেয়েছে দেশ, পতাকা ও নাগরিকত্বের পরিচয়। বাড়িতে বাড়িতে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। চলছে রঙিন টিভি আর ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। শেষ হয়েছে এখানকার নাগরিকের ভোটার নিবন্ধন।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে তিনটি কলেজ রয়েছে। এছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দাখিল ও আলিম মাদরাসা গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ছিটমহলগুলোতে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। পাঁচটি বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে আট হাজার ৫০৪টি বাড়িতে বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে অন্ধকারে ঢেকে থাকা প্রতিটি ছিটমহল। সড়ক, কালভার্ট, সেতু, বাজার, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে।

তিন বছরে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বিলুপ্ত ছিটের ১১০৯ জনকে বয়স্কভাতা, ৪৭৪ জনকে বিধবা ভাতা এবং ২৪৭ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। ছিটের সব নাগরিককেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় আনা হবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

গাড়াতি ছিটের সাবেক চেয়ারম্যান ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মো. মফিজার রহমান বলেন, আমরা দেশ, নাগরিকত্ব পেয়েছি। বিদ্যুত্ জ্বলছে আমাদের এলাকায়। আমরা দীর্ঘ ৬৮ বছরেও যা পাইনি তা মাত্র একবছরের মাথায় অধিকাংশ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও জানান, ছিটমহলগুলোতে গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দিয়ে দ্রুত এমপিওভুক্ত করা, চাকরি ক্ষেত্রে কোটা নিশ্চিত করা এবং রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হলেই দেশের সবচেয়ে সুখী এলাকার বাসিন্দা হবে বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দারা।