টেকসই উন্নয়নে নারীর জন্য বিনিয়োগ

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের বরাদ্দ ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা বেশি। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ বিনিয়োগে নারীরা কতখানি উপকৃত হবেন, আর যতটা হবেন না। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সেসব বিষয়ে কথা বলে লিখেছেন –
[টেকসই উন্নয়নে নারীর জন্য বিনিয়োগ]
একটি মনিটরিং সেল প্রয়োজন

আয়শা খানম

সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে এবং পরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দুটি সভা করে। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নে অর্থনৈতিক যোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের নারী আন্দোলন জেন্ডার বাজেট নিয়ে কাজ শুরু করে। এই ধারাবাহিক কাজের একটি অর্জন হচ্ছে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে এখন জেন্ডার বাজেট হয়েছে। ভিশন ২০-২১-এ আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে নারীকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাষ্ট্রের উন্নয়নের কথা বলে, এখানে জেন্ডার বাজেট খুবই প্রয়োজন। পাশাপাশি এই বরাদ্দকৃত অর্থ কিভাবে কোথায় নারীর জন্য বরাদ্দ হচ্ছে, কোথায় খরচ হচ্ছে তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি মনিটরিং সেল হওয়া প্রয়োজন। কারণ ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বাজেট থাকলেও সেখানে অনেক মন্ত্রণালয় অর্থ খরচ করতে পারেনি। সমান অংশীদারিত্বের কথা সব জায়গায় বলা হলেও তার কোনো প্রতিফলন বাস্তবে আমরা দেখি না। রাষ্ট্র যে বিনিয়োগ করছে তা আমাদের নারীর জীবনে কি ফলাফল আনছে এবং আমাদের গুণগত মানের কি পরিবর্তন হচ্ছে সেই বিষয়টি দেখতে হবে। নারীর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এটা সত্যি কিন্তু এই অগ্রগতি ও উন্নতির সুবাতাস কতটুকু নারী পাচ্ছে তা আমাদের দেখতে হবে। এর ভিত্তিতে নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার ইকুয়ালিটির বিষয়ে জেন্ডার বাজেটে নারী কতটুকু উপকৃত হয়েছে সে বিষয়টি আলোচনায় আসা দরকার। নারী আন্দোলন ৮০’র দশক থেকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে তার আলোকে বাজেট ও বাজেট বরাদ্দের বিষয়গুলো আলোচনায় আনা শুরু করেছে। জাতীয় বাজেটে নারীর বিষয়টি আসলে কিছু চিন্তা-ভাবনা বা কিছু কৌশল রয়েছে, এগুলো নারীর জন্য আসলে কতটা ইতিবাচক সেই প্রশ্ন থেকে যায়। মনিটরিং টুল নিয়ে আমাদের পদ্ধতিগতভাবে ভাবতে হবে অ্যাপ্রোচ দেখতে হবে। বাজেটে রাজনৈতিক মতাদর্শে একটি প্রতিফলন দেখা যায়। সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। নারী আন্দোলন মনে করে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাবৃদ্ধি ও দক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন।

নারীর জন্য তেমন কোনো বার্তা বহন করে না

শরমিন্দ নীলোর্মী

সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে অনেক অগ্রযাত্রা হওয়ার পরও নারীর জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখি। বর্তমানে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। নারীর জন্য জেন্ডার বাজেট প্রয়োজন, কারণ অনেক সময় খোলা চোখে জেন্ডার নিউট্রাল বাজেট মনে করা হয় কিন্তু আসলে তা নারীর জন্য তেমন কোনো বার্তা বহন করে না। জেন্ডার বাজেটে নারীর জন্য আমরা চাই নিরাপত্তা, লাভজনক কাজ, নারীর চলাচলের সুবিধা, নারী স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ওনারশিপ। বিগত বছরের বাজেটে বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে যে কার্ড কৃষকদের দেয়া হবে সেখানে নারী কৃষকদের আলাদা কার্ড দেয়া হবে। যা সরকারের ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। পাশাপাশি কৃষক হিসেবে নারীর যে অবদান তা পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। লেবার ওয়েলফেয়ার সার্ভিস সেন্টারের মতো জায়গায় আরও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ডেকেয়ার সেন্টার কর্মজীবী মায়েদের জন্য খুবই প্রয়োজন। ভোকেশনাল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কম এটা বৃদ্ধির জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ বিশেষ জায়গায় বিনিয়োগ বাড়িয়েও নারীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের জিডিপি যতটা এগুচ্ছে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ততটা বাড়ছে না। অথবা বিনিয়োগ ঠিকমতো বাড়ছে না। তিনটি আঙ্গিকে যদি বিষয়টিকে দেখি। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, সাসটেইনেবল ডেভেলেপমেন্ট গোল এবং আর্থিকভাবে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ। এ বছর সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বাজেটে এক ধরনের শিফট হয়েছে। জেন্ডার বাজেটের উদ্দেশ্য নারী এবং পুরুষ উভয়কেই ত্বরান্বিত করা, যার মূল লক্ষ্য হল উন্নয়ন। ৪০টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ৩৬টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেট বেড়েছে, ৬টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেট কমেছে। শিক্ষা ও কমার্স মন্ত্রণালয়ের বাজেট কমেছে। ডে কেয়ার সেন্টারের কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ডে কেয়ার সেন্টার নেই। এ ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেট নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে দক্ষতা আরও বাড়ানো দরকার।

অংশগ্রহণমূলক বাজেট চাই

অধ্যাপক ড. নাজমা বেগম

চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমরা অংশগ্রহণমূলক বাজেট চাই। আমরা অনেক ধরনের আলোচনা দেখি বাজেটের আগে, কিন্তু এর প্রতিফলন আমরা অনেক সময়ই দেখি না। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, নারীর জন্য অনেক বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন অনেক কম। আমাদের অনেক ভালো ভালো পলিসি আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। আর এ জন্য প্রয়োজন মনিটরিং। লেবার ফোর্সে ৫৭% নারীর কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই, কারণ তারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। নারীর উন্নয়নে এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর উন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য কমানো এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশি। জেন্ডার বাজেট নিয়ে যে রিপোর্টগুলো আমরা দেখি এই রিপোর্টগুলো শুধু সংখ্যারভিত্তিতে না গিয়ে গুণগত মানের দিকে আরও গুরুত্ব দেয়া দরকার। ২০১৬-১৭ বাজেটে এসডিজির গোল ফাইভের লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইলে নারীর জন্য আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। একটি বাজেট যখন নারীর ক্ষমতায়নে, দক্ষতা বাড়াতে এবং অন্যের ওপর নারীর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করে সেরকম একটি বাজেটকেই আমরা জেন্ডার বাজেট বলতে পারি। কৃষি ক্ষেত্রে যে বাজেট কমানো হয়েছে তার একটি প্রভাব নারীর ওপর পড়বে। কারণ নারীরা এক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত থাকে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে আমি মনে করি অদক্ষ ব্যবহার বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সুতরাং দক্ষতার সাথে বাজেট বরাদ্দ ব্যবহারকরণ প্রয়োজন।

জেন্ডার বাজেটে অ্যাকশন প্ল্যানের উল্লেখ নেই

নাজনীন আহমেদ

সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস

বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দের পরিকল্পনা ও মনিটরিংয়ের সময় সে বরাদ্দ নারী উন্নয়ন নীতির কর্মকৌশল অনুযায়ী হচ্ছে কি না তার একটি খতিয়ান আগামী অর্থবছরের জেন্ডার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কারা কাজ করছে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকা দরকার। নারীর উন্নয়নে নারীনীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল অনুসরণ করে বাজেট বরাদ্দ করা এবং জেন্ডার বাজেট রিপোর্টে এর প্রতিফলন দরকার। জেলা পর্যায়ে কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল ও ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা। নারীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, ৪০ বছরের কম বয়সী নারীদের আয়ের উৎস বাড়ানোর জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের জন্য বাজেটে গুরুত্ব দেয়া। ইউনিয়ন কৃষি ব্লকভিত্তিক নারী কৃষি শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করা। পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সংবেদনশীল করার উদ্যোগ বেগবান করতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো। নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১তে আমরা পেয়েছি নারী উন্নয়ন নীতির সঙ্গে বাজেটকে আলোচনায় আনতে হবে। নারী উন্নয়নের জন্য আমাদের একটি অ্যাকশন প্ল্যান আছে কোনটি কত সময়ের মধ্যে শেষ হবে। এখন আমাদের দেখার সময় কোন কোন পরিকল্পনা আমরা শেষ করতে পেরেছি কোনগুলো এখনও হচ্ছে। জেন্ডার বাজেটে নারী উন্নয়ন নীতির কথা বলা আছে, কিন্তু অ্যাকশন প্ল্যানের কথা বলা নেই। অ্যাকশন প্ল্যানের সঙ্গে বাজেট থাকলে আমরা বলতে পারব আমরা কতটুকু অগ্রসর হয়েছি। লেবার ফোর্সে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমানে ২.৫% কমে গেছে। নারীর ভূমিকার পরিবর্তনের জন্য এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বাজেটে একটি বড় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

এক নজরে

জেন্ডার বাজেট রিপোর্ট ২০১৫-১৬ এর তথ্যে জানা যায়, ৪০টি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বাজেটে নারীদের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট জেন্ডার বাজেট (কোটি টাকায়) ৫৯ হাজার ৭৫৬-এর মধ্যে নারীর উন্নয়নে ২৭.৬৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট জেন্ডার বাজেট (কোটি টাকায়) ৬৪ হাজার ৮৭-এর মধ্যে নারীর উন্নয়নে ২৬.৭৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট জেন্ডার বাজেট (কোটি টাকায়) ৭৯ হাজার ৮৭-এর মধ্যে নারীর উন্নয়নে শতকরা ২৬.৮০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। এতে লক্ষ্য করা যায়, বিগত তিনটি অর্থবছরের শতাংশের হিসাবে প্রায় একই রকম। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট উন্নয়ন বাজেটের ৪৬.৩২ শতাংশ নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের ৪২.১৮ শতাংশ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের ৩৮.৪২ ভাগ নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এতে জানা যায়, উন্নয়ন বাজেটের মোট বরাদ্দের অংশহিসেবে জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ কমছে। উন্নয়ন বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দ না বাড়ালে নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার অনেক উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

এবারের অর্থবছরের জেন্ডার বাজেট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে যত নারী আছে, তাদের জন্য এই টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিষয়টি মোটেও তেমন নয়, সরকারি নারী চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, বেসরকারি স্কুল-কলেজের নারী শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, নারী-নির্যাতন বন্ধসহ নারীর জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যে সব সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যয়ভারের যোগফলই হচ্ছে এই বাজেট বরাদ্দ।