বিপিও বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

জুনাইদ আহমেদ পলক: বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার নাম বিজনেস প্রসেসিং আউটসোর্সিং বা বিপিও। আমাদের লক্ষ্য এই বাজারে নিজেদের অবস্থান জোরদার করার পাশাপাশি স্থানীয় আউটসোর্সিংয়ের বাজারকে সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধ করা। বাংলাদেশের বিপিও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বছরে ১০০ শতাংশের বেশি, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৩০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে শুধু বিপিও খাতের কার্যকর প্রতিফলনের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনীতিতে বিপুল উন্নতি সাধন করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অনেক দেশ এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারত এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
আইসিটিতে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনের গল্প, সেখানে এই মুহূর্তে গত সাড়ে ৭ বছরে অর্থাত্ ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখেরও বেশি তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে শুরু করে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেন্টার (বিপিও), সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আমাদের আইসিটি সেক্টরের ফ্রিল্যান্সিং আপওয়ার্ড সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে আমরা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’র রূপকল্প দিয়েছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য সন্তান, আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের তত্ত্বাবধানে আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এর আলোকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে বলে সবাই আশাবাদী। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বনির্ভর সোনার বাংলার পরিবর্তিত রূপ।
২০২১ সাল নাগাদ যে মধ্যম আয়ের দেশ বিনির্মাণের জন্য রূপকল্প দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, সেখানে তিনি আমাদেরকে সেভেন্থ ‘ফাইভ ইয়ারস প্ল্যান’-এ তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাক্রমে আমরা ২০২১ সাল নাগাদ ৫০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আইসিটি শিল্প থেকে আয় করতে পারব বলে আশাবাদী। এবং সেই সময়ে আমাদের জিডিপিতে ৫ শতাংশ অবদান থাকবে আইসিটি শিল্প থেকে এবং এই ৫ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট আরনিং এবং ৫ শতাংশ জিডিপি কন্ট্রিবিউশনের জন্য আমরা ২০ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আগামী ৫ বছরে করতে সক্ষম হবো।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা প্রায় ৬৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে সারাবিশ্বের জনতান্ত্রিক বিভাজনের যে গবেষণা সেখানে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স ৩৫ বছরের নিচে এবং ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বছরের নিচে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭০ সালে নাইজেরিয়া এবং সাউথ কোরিয়া একই ধরনের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু আজকে আমরা সকলে জানি যে, সাউথ কোরিয়া বিগত ৪০ বছরে তাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে, কিন্তু নাইজেরিয়া সেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডটি কাজে লাগাতে না পারার কারণে সেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তাই আমরা মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে চাই। আমাদের প্রাইমারি বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদালয় পর্যন্ত এই মুহূর্তে ৪ কোটি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান। এই ৪ কোটি শিক্ষার্থী তাদেরকে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আমরা আইসিটি বিষয়কে ‘ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ’ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করেছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প আমাদেরকে ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন। ‘লিভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ ইমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স’ এই প্রকল্পের আওতায় আইসিটি ডিভিশনে যারা উপশহর বা মফস্বল শহরে বসবাস করছে, তাদের জন্য আমাদের ৫৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার ট্রেনিং প্রোভাইড করার জন্য একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে আমরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছি এবং আশা করছি আগামী ৩ বছরে ৫৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার আমরা সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেব। এ ছাড়াও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ৩ হাজারকে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে।
সারাবিশ্বে ৪০টি দেশে এই মুহূর্তে আমরা আইসিটি সেক্টর থেকে রফতানি করি। আমরা যে ৩৩ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করি তার মধ্যে কিন্তু ২৮ বিলিয়ন ডলার আসে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে। এই মুহূর্তে এমন আর কোনো প্রডাক্ট নাই যে যেখান থেকে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আমরা রফতানি আয় করতে পারি। একমাত্র আইসিটি সেক্টর যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে এবং আইসিটি অ্যাডভাইজার সজীব ওয়াজেদ জয়ের সুপরামর্শে এই সেক্টরকে টার্গেট নির্ধারণ করেছি যে, আমরা ২০২১ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করব। সেখানে ইউএসএ, ইউকে, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়াসহ ৪৪টি দেশে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো এক্সপোর্ট করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের টাইগার আইসিটি কোম্পানি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে ‘ন্যাশনাল স্মার্টকার্ড প্রজেক্ট’-এ ৪৩ বিলিয়নের প্রজেক্ট বাংলাদেশের কোম্পানি পেয়েছে, যেটা সরাসরি বাংলাদেশের রফতানি আয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইতোমধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সারাবিশ্বের কাছে আমরা চ্যাম্পিয়নে পরিণত হয়েছি। আমাদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতিদিন ৫০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। বিল গেটস তার ‘বিল ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মোবাইল ব্যাংকিং সলিউশন ‘বিকাশ’-এ ইনভেস্ট করেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিল গেটস বলেছেন যে, ‘প্রযুক্তিকে দুর্দান্তভাবে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।’ গত জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে আইটিইউ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আইসিটি সাহটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে, জাতিসংঘের আইসিটি সেক্টরের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ও সম্মান।
ইউএসএ, ইউরোপ, জাপানে এই মুহূর্তে প্রোগ্রামারের প্রয়োজন প্রায় ২০ লাখ। আগামী ৫ বছরে ২০ লাখ প্রোগ্রামার কোডারের প্রয়োজন হবে জাপান, ইউরোপ, আমেরিকাতে। তাদের সেই তরুণ জনগোষ্ঠী নেই, জাপানে ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী হচ্ছে ৫০-এর ঊর্ধ্বে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাদের তরুণ প্রজন্মের সঙ্কট বিরাজ করছে। তাই বাংলাদেশে গত ২ বছরে ৩০ হাজার কিশোর-তরুণকে আমরা প্রোগ্রামিংয়ের ট্রেনিং দিয়েছি। ইতোমধ্যে সারা বাংলাদেশে ২৯০১টি যে বিদ্যালয়, আমরা ২৯০১টি ‘শেখ রাসেল কম্পিউটার ল্যাব ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব’ তৈরি করেছি। আমরা আশা করছি, আগামীতে এসব ল্যাব ব্যবহার করে আরও দক্ষ তরুণ গড়ে উঠবে। এর মধ্য দিয়ে আগামী ৫ বছরে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের যে প্রোগ্রামার সঙ্কট রয়েছে সেটা আমরা বাংলাদেশ থেকে আমাদের তরুণদেরকে তৈরি করে সারা বিশ্বের প্রযুক্তিতে সার্ভিস দিতে পারব।
আমাদের প্রযুক্তি গ্রহণের যে হার, তাতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৩ কোটিরও বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আমাদের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে এখন ৬ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং আমাদের বিদ্যুত্ যেটার ওপরে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে আমাদের আইসিটি সেক্টর, সে বিদ্যুতের উত্পাদন গত সাড়ে ৭ বছরে প্রায় ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমস্ত সরকারি অফিস এখন ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় চলে এসেছে। সবখানে এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া। ই-গভর্ন্যান্স, ই-এডুকেশন, ই-কমার্স থেকে শুরু করে ই-অ্যাগ্রিকালচার এবং ই-মেডিসিন পর্যন্ত এর শাখা বিস্তৃত।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে, যারা দেশ গঠনের অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য নিজেদেরকে গড়ে তুলছে। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করা। এই বিপিও খাত ২০২১ সালের মধ্যে এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশে মোট ২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
২০০৮ সাল থেকে হাঁটি হাঁটি করে আমাদের যে খাতের সূচনা হয়েছিল তা এরই মধ্যে একটি সম্মানের জায়গা তৈরি করতে পেরেছে, নিজেদের সক্ষমতা ও উল্লেখযোগ্যতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিপিও সেক্টর বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা।
নতুনরা গড়বে দেশ, ডিজিটাল হবে বাংলাদেশ
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।