দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের নব্য শিল্পায়িত দেশগুলোয় মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের সুযোগ ও প্রেক্ষাপট কাজে লাগিয়ে যে অভূতপূর্ব (যা ছিল ইস্ট এশিয়ান মিরাকলখ্যাত) সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার মূলে সেসব দেশে ১. বিশ্বায়নে অবগাহন এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণে সচেতন ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ ২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও আয়োজনকে একটা পরিশীলিত ও টেকসই প্রেক্ষাপটে স্থাপন ৩. যেকোনো মূল্যে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে বহির্বাণিজ্যে সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিতে রফতানি উদ্যোগ বৃদ্ধি ৪. টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার শক্ত ভিত নির্মাণ ৫. আন্তঃদেশীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত সত্ত্বেও বাণিজ্য বিনিয়োগ সম্প্রসারণের স্বার্থে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব প্রদান ৬. মানবসম্পদকে পুঁজি হিসেবে রূপান্তরে পর্যাপ্ত কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা ও উন্নয়নে অধিকতর মনোযোগ ৭. অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে একটা দেশাত্মগত দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ এবং পুঁজিবাজারের সংস্কার সাধন ৮. শ্রমবাজারকে সুসঙ্গতকরণে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি ও অবাধ অভিবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ ৯. বেসরকারি পুঁজিবাজার সৃষ্টিতে তথ্যপ্রযুক্তি প্রবাহে বাস্তবানুগ আইন প্রণয়ন ও উত্সাহ প্রদায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ ১০. বিদেশী প্রযুক্তির প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ এবং কৌশলগত কারণে বিশেষ বিশেষ শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ ১১. রফতানি উন্নয়নে মৌলিক শিল্প ও উদ্ভাবনী শিল্পশক্তির সমন্বয়ের দ্বারা পণ্য বহুমুখীকরণ ১২. বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তন প্রেক্ষাপটকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনায় রেখে সচেতন বিবেচনায় এনে শিল্প বিনিয়োগ নীতিমালাকে সংস্কার ও উদারীকরণ এবং সর্বোপরি ১৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার কারণে অভূতপূর্ব শিল্পোন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। তাইওয়ান মূল ভূখণ্ড চায়নার সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাতে গিয়ে যুদ্ধে মেতে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড থামিয়ে বসে থাকেনি, রাজনৈতিক জেদাজেদিতে তাদের শিল্প বিকাশের নীতি বাস্তবায়ন সংকল্পে চিড় ধরাতে পারেনি। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থাকলেও কোরিয়ার জনগণ ও সরকার দেশের শিল্প অবকাঠামো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত হয়নি। জাতীয় সংহতিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে মালয়েশীয় অর্থনীতিকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গড়ে তুলতে মাহাতির মোহাম্মদের নেতৃত্ব ছিল অবিসংবাদিত। দুর্নীতি ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ফিলিপাইনের নাগরিকরা বেসরকারি খাতের বলিষ্ঠ বিকাশের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেই চলেছে। সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড সবাই যার যার দেশে এগিয়ে চলেছে। এ উপমহাদেশের শ্রীলংকা ও ভারত, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রশ্নে ভেতরে যত দ্বন্দ্ব ও বিবাদ-বিসংবাদ থাকুক না কেন, সব পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত। জাপানি অর্থনীতিবিদ এস ইচিমুরা তার ‘দ্য রোল অব জাপান ইন এশিয়া’ (১৯৯৩) গ্রন্থে জাপান ও পূর্ব এশীয় কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণগুলোর তালিকায় দেখিয়েছেন জাপানের ক্ষেত্রে— ১. উচ্চহারে পুঁজির সংস্থান ২. উচ্চহারে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধি ৩. পরিশ্রমী ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক শক্তি ৪. কৃষি খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ৫. বিদেশী ও জাপানি প্রযুক্তি অনুধাবন ও প্রয়োগে উন্নত মেধা ৬. উন্নত শ্রম ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিক-উত্পাদন মালিকানার মধ্যে মেলবন্ধন ৭. কার্যকর রাজস্ব ও মুদ্রানীতি ৮. উচ্চগুণ ও ক্ষমতাসম্কন্ন শিল্পনীতি ৯. ব্যাংক সেক্টর কর্তৃক বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাকে উপযুক্ত পরামর্শ ও প্রযত্ন প্রদান এবং ১০. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ইচিমুরা দেখিয়েছেন, অনেকগুলো কারণের মধ্যে সেরা ১১ কারণ পূর্ব এশীয় অর্থনীতি নিচয়কে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছিয়েছে— ১. উচ্চহারে পুঁজি সংস্থান ২. অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধি ৩. কৃষি ও শিল্প খাতে উপযুক্ত প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ ৪. দক্ষ শ্রমিক শক্তি ৫. নিয়ন্ত্রিত জন্মহার ৬. রফতানিমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা ৭. যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সহযোগিতা ৮. তুলনামূলকভাবে পরিবেশের উন্নত ভারসাম্য বজায় ১০. অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগী বেসরকারি ও সরকারি আমলা সৃষ্টি এবং ১১. সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকা। এসব দেশে এ চেতনাই সর্বত্রগামী হয়েছে যে, জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনাকে সামগ্রিকতায় রূপ দিতে হবে। পরস্কর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বা থেকে সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। সময়ের দাবিকে সুবিবেচনায় এনে প্রাপ্ত সমুদয় সুযোগ সদ্ব্যবহারে যে দেশ যতখানি সক্ষম হয়েছে, সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ততখানি সুদৃঢ়করণ সম্ভব হয়েছে। সময়সূচি অনুসরণে, লাগসই পন্থা অবলম্বনে এবং জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সাফল্য সুদূরপরাহত রয়ে গেছে যে পরিবেশে, সেখানে শিল্পোন্নয়ন এখনো দুঃস্বপ্ন বৈকি।
প্রথাগত রীতিনীতি প্রয়োগ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা ও পরিবীক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে এবং বহিরারোপিত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় অভিনয়ে সময়ক্ষেপণের অবকাশ নেই। এ কথা জাপান গত শতকের শুরুত্বেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই তারা শত বাধা-বিপত্তি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় (এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও) মোকাবেলা করেও তাদের শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের ধারাকে টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। ১৮৬৮ সালে মেইজি যুগ শুরু হওয়ার পর জাপান প্রথম বিশ্বাভিমুখী হওয়ার চিন্তা-চেতনাকে নিজেদের মেধা ও মননের সৃজনশীলতায় সর্ম্পণ করে। এ সময়ে তারা সরকারি আমলা ব্যবস্থাপনাকে বেসরকারি আমলায় উত্তরণ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। দেশীয় অর্থনীতির সঠিক স্বার্থ রক্ষায় জাপানের সরকার, আমলা ও জনগণের একনিষ্ঠতায় কোনো ঘাটতি নেই। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ কিংবা বৈষম্যের দেয়াল তোলার অবকাশ নেই। রিয়াল এস্টেট ব্যবসায় অর্থলগ্নিতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ব্যাংক ব্যবসাকে ট্যাক্সপেয়ারের মানি ভর্তুকি দিয়ে টেনে তোলার মতো আপাত হঠকারী হিসেবে প্রতীয়মান পদক্ষেপ নিতেও তারা কুণ্ঠিত হয় না। কেননা অর্থনীতির চলত্শক্তি বজায় রাখার স্বার্থে জনমত সেখানে সদাজাগ্রত এবং গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার প্লাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে মিডিয়া সবসময় নীতিনির্ধারণে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। জাপানিরা যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে জানে। আজ আর কালের মধ্যে, নিজেদের দলগত স্বার্থ আর শাসনামলের মধ্যে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনাকে বেঁধে ফেলে না, নিজেদের আখের গোছানোর উদ্দেশ্য নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে না। পরিপোষণমূলক সহায়তা দেয়ার প্রশ্নে দল বা সমর্থকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করে না, রীতিনীতি ও পদ্ধতি প্রবর্তনে ক্ষুদ্র স্বার্থবাদিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না— জাপানি অর্থনীতি বিকাশের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ প্রশ্নে এটাই মোদ্দাকথা। সে দেশে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কারা এল বা গেল— সেখানকার ‘কাশিমবাজার কুটি’ থেকে তার তত্ত্বতালাশ চলে না। চিয়োদা কু’র বড় কোম্পানিগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলোও কখনো বিচলিত হয় না কিংবা মাথা ঘামায় না কাশিমাগাসেকীর সরকারি সচিবালয়ে কে এল বা গেল। পদলেহন, দলাদলি, লাল-সাদা-নীল গ্রুপবাজির কোনো ব্যাপার সেখানে নেই। অতীতেও কি ছিল? কিছুটা হয়তো ছিল গত শতাব্দীর প্রথম তিন-চার দশকে, যখন সেখানে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র্ত্র ও বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল।
জাতীয় অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে সরকারি খাতের পরিপূরক ভূমিকা পালনের অনিবার্য অবকাশ আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় বিগত তিন দশকে গৃহীত ব্যবস্থা ও অর্জিত সাফল্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব দেশে বেসরকারি খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে এ খাতের বলিষ্ঠ বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতার দিকে তাকানো যাক। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে ক. দুর্বল ও নগণ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খ. ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা উদ্ভূত সমস্যা গ. জাতিগত রেষারেষি ঘ. ভর্তুকি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার আবর্তে সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার অবস্থান ছিল দুষ্টু ক্ষতের ন্যায়। দূরদর্শী নেতৃত্ব এ অবস্থা থেকে মালয়েশীয় অর্থনীতিকে টেনে তুলতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশজ সামগ্রী ও প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বারা ভ্যালু এডিশন বাড়িয়ে রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ এবং ক্রমান্বয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ। আর এ কাজে অন্যতম সহায়ক হয় দেশের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য খাত থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করে বেসরকারি খাতকে টেনে তোলার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক অবস্থানে ছিল, প্রথমে সেগুলোকেই বিরাষ্ট্রীয়করণ তথা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় রূপান্তরের মাধ্যমে মূলত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে পর্যায়ক্রমে স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে এসব বৃহত্ শিল্প সেক্টরকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে সহায়তা করা হয়। মালয়েশিয়ার বিদ্যুত্, টেলিফোন, বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতকে প্রথম পর্যায়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রের পরোক্ষ প্রযত্ন ও পরিপোষণের মাধ্যমে এসব অবকাঠামোগত খাতকে দুর্বলতা কাটিয়ে শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভর হতে সহায়তা দেয়া হয়। সত্তর ও আশির দশকে এ অভিজ্ঞতার আলোকে অন্য সব সেক্টরকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে বর্তমানে পুত্রজায়ায় সরকারের রাজধানী স্থানান্তরের মতো গোটা সরকারি নির্মাণ কার্যক্রমও বাস্তবায়ন হচ্ছে বেসরকারি খাতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। সরকার অর্থ জোগান দিয়ে বেসরকারি খাতকে সরকারি নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করে যাচ্ছে। পাবলিক সেক্টরের বশংবদ অদক্ষতা রেন্ট সিংকিংয়ের সমস্যা বেসরকারি খাতে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি খাতের দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ ব্যবস্থাপক, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তরাই উপযুক্ত বেতনে ও সহায়তায় বেসরকারি খাতের উন্নয়নে তাদের মেধা ও মনন সৃজনশীল কাজে লাগাচ্ছেন। সরকারি রীতি পদ্ধতি সীমাবদ্ধতার দেয়ালে আটকানো সরকারি কর্মতত্পরতা বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। মালয়েশিয়ার বেসরকারীকরণের অত্যুজ্জ্বল অভিজ্ঞতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মডেল।
এখন অধিকাংশ দক্ষিণ এশীয় অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুখ্য উত্স ও নিয়ন্তা। পাবলিক সেক্টর সেখানে প্রাইভেট সেক্টরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্যতম অংশীদার। সরকার এখন আর ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শিল্পোত্পাদন ব্যবস্থাপনায় নেই। সরকারি উদ্যোগ এখন শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ আর বাজার অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর নীতিমালা নির্ধারণ ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সহায়তা প্রদানে সচেষ্ট। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম দশকে মালয়েশীয় নেতৃত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে এমন একটা শক্ত ও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সত্তরের দশকে একবার এবং ১৯৯৭ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় সাফল্যের সঙ্গে টিকে যায় দেশটি। বিগত দুই দশকে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন প্রয়াসে নেতৃত্বদানকারী প্রধানমন্ত্রী মাহাতির মোহাম্মদের উন্নয়ন দর্শনের (ভিশন ২০২০ নামে খ্যাত) মূল কথা ছিল— পুরো মালয়েশীয় অর্থনীতিকে ইনকরপোরেটেড অর্থনীতিতে পরিণত করা এবং একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মালয়েশিয়াকে শুধু স্বয়ম্ভর করে তোলা নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ উপযোগী করে তোলা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি আন্তঃসহায়ক শক্তি সর্বদা বিদ্যমান। শত সংকট সন্ধিক্ষণেও একটি অন্তঃসলিলা (শক্তি) প্রেরণা অর্থনীতিকে সচল রাখতে সচেষ্ট থাকে। তা না হলে শত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অপচয়-অবচয়-অবক্ষয়-আত্মসাত্ আর নানা ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা লোকসানি পদক্ষেপের কবলে থেকেও অর্থনীতিতে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান গতি থাকত না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাও এমন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হতো না। অর্থনীতিকে বেগবান করার প্রতিশ্রুতি ও প্রয়াসের কথা বলে নানা মডেলে এক্সপেরিমেন্ট চালানোয় বিভিন্ন সময়ে ভিন্নধর্মী নীতি গ্রহণ এবং তাতে মূল্যবান সময় ব্যয়, অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দুর্বলতায় আত্মসাত্ ও অপব্যয় সত্ত্বেও অর্থনীতির স্বাভাবিক অগ্রগতি বিদ্যমান। সবার স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণে অর্জিত সাফল্য আত্মতুষ্টির আত্মপ্রচারণা উত্সারিত অনুত্পাদনশীল পদক্ষেপে অর্থনীতির অন্তঃসলীলা শক্তি যেমন অবক্ষয়ের শিকার হয়, তেমনি গণ-অংশায়নে স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় ঘটে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি। নেতিবাচক মনোভাবে সামাজিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভবনার স্বর্ণতোরণ সুদূরে মিলায়।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক