ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বিপিও খাতের বয়স সমসাময়িক। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে আজ অবধি, এই সাড়ে ৭ বছর সময় একটি দেশ, একটি ব্যবস্থাপনা এবং একটি স্বপ্ন পরিবর্তনের জন্য পরিব্যাপ্ত নয়, অনেকটা দুঃসাধ্যই বলা চলে। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের নেতৃত্বে সেই অসাধ্য সাধনে আমরা আজ লক্ষণীয়ভাবে এগিয়ে চলেছি। এই নিরলস পরিশ্রমের ফসলও বাংলাদেশ ঘরে তুলতে শুরু করেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল। প্রায় শূন্য হাতে যাত্রা করা ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ ৪০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করছে আর এই ডিজিটাল কর্মযজ্ঞে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং এককভাবে আয় করছে ১৮ কোটি মার্কিন ডলার। সস্তা শ্রম, দক্ষ জনশক্তির প্রাচুর্য ইত্যাদি ফ্যাক্টরের ফলে বাংলাদেশ বিপিও খাতে এগিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা জাগিয়েছে।
আমাদের রয়েছে একদল কর্মঠ ও উদ্যমী তরুণ জনশক্তি, যাদের ৬৫ শতাংশের বয়স এখনও ৩৫ বছরের নিচে। এসব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বিবেচনায় এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে সরকার এই খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যেমন_ ফ্রিল্যান্সিং ও টপআপ প্রশিক্ষণ প্রদান, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপন ও ২০০১টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, হাইটেক পার্ক ও আইটি পার্কে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন ইত্যাদি অন্যতম। এ রকম আরও নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ আইসিটি ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার সরকারের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি পেশায় তরুণরা আজ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। দেশে-বিদেশে তাই আজ বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং পেশায় তরুণদের আগ্রহ ও সক্ষমতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে।
বাংলাদেশে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও একটি নতুন খাত হলেও আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এটি সম্ভাবনাময় খাত। মাত্র ৩০০ কর্মী নিয়ে ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই খাতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী কাজ করছে। শুধু কর্মী সংখ্যায় নয়, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিপিও খাত প্রায় ১৮০ মার্কিন ডলার আয়ের মাধ্যমে প্রায় শতভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে শুধু বিপিও খাতের বিকাশে কার্যকর প্রতিফলনের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনীতিতে বিপুল উন্নতি সাধন করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অনেক দেশ এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য আর্থিক প্রবৃদ্ধি সাধিত করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, শ্রীলংকাও বিপিও সেক্টরে ভালো করছে। বিপিও খাতে যুগোপযোগী কর্মযজ্ঞের ফলে ফিলিপাইনও আজ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই সেক্টরে সারাবিশ্বের প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ভারত ১০০ বিলিয়ন, ফিলিপাইন ১৬ বিলিয়ন এবং শ্রীলংকা দুই বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এসব দেশের চেয়ে আমাদের সক্ষমতা কোনো অংশেই কম নয় বরং ঢের বেশি। আমার বিশ্বাস, এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। তবে একটি বিষয় আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বিশ্বের যেসব দেশ বিপিও খাতে ভালো করেছে তারা সবাই নিজেদের অভ্যন্তরীণ খাতের বিপিও শিল্পকেও শক্তিশালী করেছে। যেমন ভারত এ বছরে তাদের বিপিও খাত থেকে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার আসবে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে। এর অর্থ হলো বিশ্ব বাণিজ্যে ভালো করার জন্য আমাদের বিপিও খাতকে অভ্যন্তরীণ মার্কেটেও শক্তিশালী করতে হবে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে; কিন্তু সে হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দুরূহ। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য সম্মানজনক ও উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জুতসই মাধ্যম হলো বিপিও। তাই স্থানীয় পর্যায়ে বিপিওকে জনপ্রিয় করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বদরবারে বিপিও খাতে বাংলাদেশে সক্ষমতা ও দক্ষতার কথা তুলে ধরতে গত বছরের মতো এ বছর দু’দিনব্যাপী আমরা বিপিও সামিটের আয়োজন করেছি। এবারের আয়োজনে মোট ১০টি সেশন ও দুটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হবে। ওই সেশনগুলোতে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অংশ নেওয়ার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বখ্যাত প্রায় ২০ জন বিদেশি স্পিকারও অংশগ্রহণ করবেন। আমরা বিপিও খাতে সফল বিদেশি উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠান ও পলিসি মেকারদের সঙ্গে দেশীয় উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠান ও পলিসি মেকারদের মধ্যকার একটি ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে আমাদের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা জানাব, আমাদের করণীয় সম্পর্কে জানব। স্থানীয় অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ববাজারে নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরার জন্যই এবারের সামিটের উপজীব্য করা হয়েছে স্থানীয় অভিজ্ঞতা, বৈশ্বিক ব্যবসা। আমাদের লক্ষ্য, স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণ করা ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এই খাত থেকে এক বিলিয়ন ডলার আয় করা এবং এক লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
সম্প্রতি টাইগার আইটি নামে আমাদের দেশীয় একটি কোম্পানি পার্শ্ববর্তী নেপালের ‘ন্যাশনাল স্মার্ট কার্ড প্রজেক্টে’ ৪৩ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, রিভ সিস্টেম আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুজ্জ্বল করছে। সারাবিশ্বে এই মুহূর্তে ৪০টি দেশে আমরা আইসিটি প্রডাক্ট ও সেবা রফতানি করে থাকি। আমরা যে ৩৩ বিলিয়ন ডলার রফতানি করি তার মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার আসে গার্মেন্ট সেক্টর থেকে। এই মুহূর্তে এমন আর কোনো প্রডাক্ট নেই, যেখান থেকে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আমরা রফতানি আয় করতে পারি। একমাত্র আইসিটি সেক্টর থেকেই তা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং উলিল্গখিত উদাহরণগুলোই সেই বিশ্বাসের মূল চালিকাশক্তি।
বিশ্বব্যাপী বড় কোম্পানিগুলো সম্ভাবনাময় নতুন নতুন কোম্পানিগুলোকে একীভূত করা, প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া ও ইউরোপের আর্থিক সংকট ইত্যাদি বিবেচনায় আজ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা স্থানান্তর করছে, কখনও নিজে দেশের অন্যত্র বা কখনও ভিন্ন কোনো দেশে বা কখনও প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কার্যক্রমের বাইরের কর্মকাণ্ডগুলোকে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও যেসব কোম্পানির প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল নেই, তারাও আজ আউটসোর্স করছে। তার মানে, খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার ঝোঁক থেকেই প্রতিনিয়ত বিপিও খাতের প্রসার ঘটছে। শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই নয়, আজকাল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও পাবলিক সার্ভিস প্রদানে এবং সরকারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছাতেও আউটসোর্স করছে। দিনে দিনে বিপিওর বাজার বাড়বে। আমাদের দেশের মতো বিপুল দক্ষ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক্সপোনেনসিয়াল হারে আউটসোর্সিংয়ের চাহিদা বাড়বে। তরুণদের বলতে চাই, শেখ হাসিনার সরকার তোমার নিজের যোগ্যতা বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, তুমি তোমার সক্ষমতা প্রমাণের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নাও। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের বিপিও খাতের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে এগিয়ে এসো, এগিয়ে যাও, এগিয়ে দাও। তোমরাই পারবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী