মধ্যরাতের ডাক্তার

মিসরের রাজধানী কায়রো কিংবা ফ্রান্সের প্যারিসের মতো ‘রাতজাগা’ নয়, তবু বলতে গেলে প্রায় পুরো রাতই জমজমাট উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ শহর বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা। কয়েকটি অস্থায়ী খাবারের দোকান খোলা থাকে সারারাত। রাস্তায় থাকেন রাতজাগা রিকশাচালকরা। কারণ, রাতে আন্তঃজেলা বাসগুলো সেখানে থামে, নামেন যাত্রীরা। আবার এই রাস্তার পাশেই মধ্যরাতে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন ডা. সামির হোসেন মিশু। প্রতিদিন রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত নির্ধারিত সময় তার এ রকম রোগীদের জন্য। রোগী বেশি হলে রাতও গভীর হয়। নিম্ন আয়ের মানুষই মূলত ভিড় জমান তার চেম্বারে। দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ, এমনকি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করেন তিনি। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি এই সেবা দিচ্ছেন। তবে সাতমাথায় এ কার্যক্রম চলছে প্রায় ১৬ বছর আগে থেকে।

বগুড়া সদর উপজেলায় ডা. মিশু কর্মরত রয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পরিচিত মুখ তিনি। স্বেচ্ছাসেবা ও সংস্কৃতিচর্চার একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তাকে প্রশ্ন করা হয়, পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, তখন কোন প্রেরণা থেকে এভাবে সেবামূলক কাজে সময় দিচ্ছেন তিনি? উত্তরে মৃদু হেসে তিনি জানান, মানুষের ভালোবাসাই তাকে উদ্বুদ্ধ করে। আর্থিকভাবে তিনি ধনী নন। নিজের কোনো গাড়ি নেই, সেটার প্রয়োজনও নেই। কারণ, যত রাতই হোক না কেন, কয়েকজন রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করেন তাকে বাসায় নিয়ে যেতে। প্রিয় ‘ডাক্তার স্যার’কে পেঁৗছে দিয়ে তবেই তারা ফেরেন নিজের ঘরে। ডা. মিশু তাদের অনেকবার বলেছেন অপেক্ষা না করার জন্য।

কিন্তু কেউই তার কথায় কান দেন না। সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসাকেই তিনি জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করেন। পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও কখনই মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নেই বলেও জানালেন তিনি।

মধ্যরাতকেই রোগীসেবা দেওয়ার সময় হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে মিশু জানান, পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন কাজ সেরে এই সময়টাই তিনি ‘অবসর’ পান। তা ছাড়া রাতে সাধারণ মানুষ জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসক খুঁজে পান না। নানা কাজে ব্যস্ত এসব মানুষও ডাক্তার দেখানোর জন্য এটাকেই ভালো সময় মনে করেন।

১৯৯৬ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মিশুর বাবা ডা. সাফদার হোসেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেই বাবার চিকিৎসা করেছেন। চিকিৎসক বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে সেবামূলক উদ্যোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করেন তিনি। পরিকল্পনা করেন দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার। প্রথমে তিনি বগুড়ার নামাজগড় এলাকার সংগঠন ‘বৃক্ষছায়া নীড়ে’র ব্যবস্থাপনায় প্রতি শুক্রবার রোগী দেখতেন। এভাবে বছর চারেক কেটে যায়। ২০০০ সাল থেকে রাতে সাতমাথায় আড্ডা দিতে শুরু করেন মিশু। সেখানে বন্ধু-বান্ধবসহ আশপাশের রিকশাচালক, চা-দোকানি ও শ্রমিকদের অনেকেই তার কাছে রোগের কথা বলে ব্যবস্থাপত্র নিতেন। হাতের কাছে পাওয়া টুকরো কাগজে তিনি লিখে দিতেন প্রয়োজনীয় ওষুধের নাম। এভাবে একসময় সাতমাথা তার মধ্যরাতের ‘চেম্বার’ হয়ে ওঠে। লোকমুখে খবর ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। অনেকে তখন এসে আগে থেকেই অপেক্ষা করতে থাকেন তার জন্য। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে একজন উৎসাহী ব্যক্তি কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার কিনে দেন তাদের বসার জন্য। সে সঙ্গে ডাক্তারেরও বসার ব্যবস্থা করা হয়। এর পর গত বছরের মার্চে আরেকজন ব্যবস্থাপত্র লেখার জন্য প্যাড ছাপিয়ে দেন। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বগুড়া টাউন ক্লাবের সামনের রাস্তায় তার ‘ডাক্তারখানা’।

ডা. মিশু জানান, অনেকেরই ধারণা, সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কারও ভুল ভাঙান না। প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারাই তার কাছে আনন্দের। সম্প্রতি সেখানকার ‘মুড়িমাখা বিক্রেতা’ শফিকের স্ত্রীর পাকস্থলীতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। মিশু তার পাশে দাঁড়ান। চিকিৎসা তো বটেই, প্রায় বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করেন তিনি। এ রকম সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে ডা. মিশু গরিব মানুষের অনেকের কাছেই ‘দেবতাতুল্য’ হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন গড়ে ২০ জন রোগী চিকিৎসা পরামর্শ নেন তার কাছ থেকে। বড় ধরনের রোগ বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে তিনি সরকারের সমাজসেবা বিভাগের সহায়তার ব্যবস্থাও করেন।

ব্যক্তিগত জীবনের বড় এক কষ্ট গোপন রেখে প্রতিদিন হাসিমুখে সবার সামনে হাজির হন মিশু। তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সদা হাস্যমুখী চঞ্চল তরুণী সাবিন আফরোজ রিমিকে। দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাদের। ২০০৭ সালের ২২ ডিসেম্বর এক দুর্ঘটনায় রিমির মৃত্যু হয়। আজও সেই দুঃসহ স্মৃতি মিশুকে তাড়া করে ফেরে। গোপনে এখনও কাঁদেন তিনি। তার ছেলে সাবিত হোসাইন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি রাজশাহী বিভাগের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলে খেলেন। মেয়ে সাবিরা ফারিহা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। বড় হয়ে বাবার মতোই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে।