মত্স্য উত্পাদনকরী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান আমাদের সমাজে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে মাছের উত্পাদন হয় ফিশারিজ ও একোয়াকালচারের মাধ্যমে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থ্া (এফএও) এ বিষয়ে বাত্সরিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এফএও’র রিপোর্ট ’দি স্ট্যাট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ এন্ড একোয়াকালচার -২০১৬’ অনুযায়ী ফিশারিজ ও একোয়াকালচার পদ্ধতিতে মত্স্য উত্পাদনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান যথাক্রমে ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ, যা হয়ত একোয়াকালচারকে বাদ দিয়ে শুধু ফিশারিজের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিশারিজ ও একোয়াকালচার সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ফিশারিজ হচ্ছে প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে (নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, উপসাগর, সাগর) মাছের, বিচরণ ক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন, পরিযান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে একটি সাসটেইনেবল পন্থায় বছরের পর বছর মত্স্য আহরণ করা। অন্যদিকে একোয়াকালচার বলতে বদ্ধ জলাশয়ে (পুকুর, ধানক্ষেত, ঘের) কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ কর্তৃক মাছের পোনা মজুদ, খাদ্য প্রয়োগ, রোগ পরিচর্যা ও নির্দিষ্ট সময় পর মত্স্য আহরণ করাকে বুঝায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে এ দুটো বিষয়কে একত্রে ‘ফিশারিজ’ বলা হয়। সমষ্টিগত এ ধারণার ফলে একোয়াকালচার একটি স্বতন্ত্র সেক্টর হিসেবে আমাদের দেশে অপরিচিত। মত্স্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট মত্স্য উত্পাদন ৩৬.৮৪ লক্ষ মেট্রিক টন। মোট উত্পাদনের ৫৫.৯৩% আসে একোয়াকালচার থেকে, বাকী ২৭.৭৯% ও ১৬.২৮% আসে যথাক্রমে অভ্যন্তরীণ স্বাদুপানি ও সামুদ্রিক ফিশারিজ থেকে। এ পরিসংখ্যান বলে দেয় বাংলাদেশে মত্স্য উত্পাদনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে একোয়াকালচার অর্থাত্ মত্স্য চাষ। পরিবেশ দূষণ ও নির্বিচারে মত্স্য আহরণের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয় বা ফিশারিজ থেকে মাছের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং একই সঙ্গে বর্ধিত জনসংখ্যার বিপুল পরিমাণ মাছের চাহিদা মিটাতে একোয়াকালচারের উপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ফিশারিজ থেকে মাছের উত্পাদন বেড়েছে ১.৬ গুণ, অন্যদিকে একোয়াকালচার থেকে বেড়েছে ৩০ গুণ। একোয়াকালচার ভিত্তিক মত্স্য উত্পাদনের মূল নিয়ামকগুলো হলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উত্পাদন, মাছের খাদ্য উত্পাদন, পরিবেশ বৈচিত্র্যানুযায়ী মত্স্য চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ। এ ক্ষেত্রে গত তিন দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট, মত্স্য অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো দৃশ্যমান ও কার্যকরী ভূমিকা রেখে আসছে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে একোয়াকালচার ভিত্তিক মত্স্য উত্পাদন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বিষয়। মত্স্য খাদ্য উত্পাদনে ব্যবহূত প্রধান খাদ্যোপাদান ফিশমিল এবং মিট-এন্ড-বোন মিল প্রায় শতভাগ আমদানিকৃত যা ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসে। এশিয়াতে একোয়াকালচার উত্পাদনকারী দেশ যেমন, ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে খাদ্যোপাদান আমদানিকৃত, যে কারণে বাংলাদেশের মত্স্য চাষিদেরকে ঐ সমস্ত দেশের চাষিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। বাংলাদেশে একোয়াকালচার ভিত্তিক মত্স্য উত্পাদন বৃদ্ধির কারণে মত্স্য আমিষের চাহিদা প্রায় মিটে গেছে।
পৃথিবীর বৃহত্ একোয়াকালচার উত্পাদনকারী দেশগুলোতে চার ধরনের সার্টিফিকেশন স্কিম চালু আছে। যেমন ফার্স্ট পার্টি সার্টিফিকেশন – উত্পাদনকারীর নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত; সেকেন্ড পার্টি সার্টিফিকেশন – বিক্রেতা বা ভোক্তা সংগঠনের মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত; থার্ড পার্টি সার্িটফিকেশন – উত্পাদনকারী বা বিক্রেতার বাইরে তৃতীয় কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত; এবং ফোর্থ পার্টি সার্িটফিকেশন – সরকার বা বহুজাতিক কোনো সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের একোয়াকালচার পদ্ধতিতে মত্স্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে এসমস্ত সার্টিফিকেশনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক বাজারে থার্ড পার্টি সার্টিফিকেশন সবচেয়ে শক্তিশালী, কারণ এর মানদণ্ড অনুযায়ী মাছচাষ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি সার্টিফিকেশন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। কারণ সার্িটফিকেশন স্কিম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ডের শতভাগ অনুসরণ। মানদণ্ড হলো সার্টিফিকেশন স্কিম বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের মূল চাবিকাঠি যা কতগুলো আইন, নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া ও নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। মানদণ্ড অনেকগুলো গুণগত এবং পরিমাণগত বৈশিষ্ট্য ও নির্দেশক নির্ধারণ করে থাকে যা চাষি এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা আবশ্যিকভাবে অনুসরণে একান্তভাবে বাধ্য। এ ধরনের মানদণ্ড সাধারণত স্টেকহোল্ডার ভিত্তিক সংলাপের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। অতি সম্প্রতি পাঙ্গাস রপ্তানির উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে দুটি প্রসেসিং প্লান্ট নির্মিত হয়েছে। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশে একোয়াকালচার উত্পাদনের প্রায় ১৫% শুধু পাঙ্গাস হওয়া সত্ত্বেও প্রসেসিং প্লান্টের জন্য গুণগত মানের পাঙ্গাস নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে পাঙ্গাস চাষ কোনো সার্টিফিকেশনের স্কিমের মানদণ্ড অনুযায়ী হচ্ছে না। সেজন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পাঙ্গাস উত্পাদনের জন্য সার্টিফিকেশন স্কিম তৈরি করা প্রয়োজন, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ইত্যাদি দেশে প্রচলিত আছে। সার্টিফিকেশন স্কিমের আওতায় একোয়াকালচার উত্পাদনের মাধ্যমে পেছনের সারির দেশগুলো সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। এফএও’র রিপোর্ট ২০১৪ অনুযায়ী ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১১তম ও ৫ম, কিন্তু এ বছর ফিলিপাইন বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে পঞ্চম স্থানে চলে এসেছে। তাই মত্স্য চাষি, খাদ্য সরবরাহকারী, ওষুধ সরবরাহকারী, মত্স্য ব্যবসায়ী, মত্স্য প্রক্রিয়াজাতকারী, মত্স্য পণ্য আমদানিকারক ইত্যাদি স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে FAO, ISEAL অথবা ISO–এর নীতিমালা অনুস্মরণপূর্বক মত্স্য অধিদপ্তর এবং মত্স্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট কর্তৃক সময়োপযোগী স্ট্যান্ডার্ড তৈরি এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একোয়াকালচার উত্পাদন বিশ্ব বাজারে প্রবেশ না করতে পেরে আরো পিছিয়ে পড়বে।
n লেখক :প্রফেসর, একোয়াকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়