ভরা বর্ষায় হাওর মানে অথৈ জলরাশি। অসীম জলরাশির বুকে কচুরিপানার মতো ভাসমান গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রাম। জীবন মানে বানালের (বাতাস আর উত্তাল ঢেউ) সঙ্গে নিত্য যুদ্ধ খেলা। এ সময় মজুত ধান (বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হাওরের বলতে একমাত্র ফসল) আর বর্ষার জলের মাছ পর্যাপ্ত হলেও শাকসবজি ফলানোর তিল পরিমাণ জায়গা থাকে না কোথাও। হাওরবাসীর খাদ্য তালিকা এ সময়টায় বড় একঘেয়ে। শাকসবজির অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে আবালবৃদ্ধবনিতারা। সেই অভাব পূরণে উদ্যোগী হয় হাওরপাড়ের এক তরুণ পল্লী চিকিৎসক। নাম তার মো. উজ্জ্বল (৩৪)। বাড়ি হাওর উপজেলা নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের গোয়ালহাটি গ্রামে। বাবার নাম মো. সফর আলী। তিনি নিজস্ব প্রযুক্তিতে হাওরের জলের ওপর তৈরি করেছেন ঝুলন্ত সবজি বাগান। তার এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছে হাওর অঞ্চলের অবকাঠামোগত জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প (হিলিপ) নামে নিকলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের একটি অংশ। ব্যক্তিগত জীবনে আইএ পাস করার পর উপজেলার দামপাড়া বাজারের একটি ঘরে ওষুধের ব্যবসা শুরু করেন উজ্জ্বল। সেই সুবাদে ৬ মাস মেয়াদি এলএমএএফ ও ফার্মাসিস্ট কোর্স সমাপ্ত করেন। পাশাপাশি পৈতৃক জমি চাষেও জড়িত। বর্ষার সময়টাতে যেসব রোগী তার কাছে আসেন তাদের বেশিরভাগই শাকসবজির অপুষ্টিজনিত। তিনি জরিপ করে দেখেন, এ সমস্যা বিশেষ করে হাওরবাসীর মধ্যেই প্রকট। শুরু হয় কৃষিপ্রেমিক উজ্জ্বলের ভাবনা। মাথায় আসে ঝুলন্ত সবজি বাগানের চিন্তা। ইতিমধ্যে পরিচয় হয় হিলিপ প্রকল্পের এসও (ক্রপ) বুদ্ধজ্যোতি চাকমার সঙ্গে। উজ্জ্বলের উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় হিলিপ। শুরু হয় উজ্জ্বলের পরীক্ষামূলক ঝুলন্ত বাগান স্থাপন কার্যক্রম। সময়টা এ বছরেরই এপ্রিল মাস। বাড়ির পাশে বর্ষায় ডুবা জমির ১ শতকের ওপর মাচা তৈরি করা হয়। পরিত্যক্ত ড্রাম কেটে ৯টি টব মাচার নিচের খুঁটিতে বেঁধে দেন উজ্জ্বল। লাউ চাষের অনুপযোগী সময় হলেও পরীক্ষামূলক লাউ বীজই পুঁতে দেন টবে। পানির ওপর হওয়ায় গরু ছাগলের হাত থেকে চারা বাঁচাতে প্রয়োজন পড়েনি বাড়তি বেড়ার। মাসখানেকের মধ্যেই পানির ওপর মাথাচাড়া দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় উজ্জ্বলের সবজি বাগান। হাওরের মানুষ দেখেন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। উজ্জ্বল জানান, এ বাগানটিতে তার সর্বমোট ১৫ হাজার খরচ হয়েছে। লাউও হয়েছে আশার চেয়ে বেশি। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রিও করেছেন স্থানীয় বাজারে। ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত প্রতিটির মূল্য। আর টবগুলোতে জৈব সারের অধিক ব্যবহারে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও কম। তিনি আরো জানান, এখন লাউ আর চাল কুমড়ার বীজ লাগিয়েছি। খরচ নেই বললেই চলে। হিলিপ প্রকল্পের এসও বুদ্ধজ্যোতি চাকমা জানান, উজ্জ্বলের সঙ্গে কথা বলেই তার চিন্তার সম্ভাবনা দেখেছিলাম। আমাদের প্রকল্পের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাকে যথারীতি আর্থিক সহায়তাও দিয়েছি। তিনি সফল উদ্যোক্তা। তার দেখাদেখি হাওরের অনেক উদ্যোক্তা এমন বাগানের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে কামালপুরের দ্বীপগ্রাম নতুনহাটিতে আরো একটি বাগান ফসল তোলার উপযোগী হয়ে উঠেছে।