রপ্তানি বাড়ছে অপ্রচলিত পণ্যে

রপ্তানি বাড়ছে অপ্রচলিত পণ্যেআবু সাইম কয়েক বছরে অপ্রচলিত পণ্য ধীরে ধীরে রপ্তানি বাজারে নিজেদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, পাট, চামড়া ও চিংড়ির পাশাপাশি বিদেশের বিভিন্ন দেশে এসব পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে বেশি কিছু পণ্যে আগের বছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- ফুল, ফল, মসলা, কসমেটিক, প্লাস্টিক, হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প, কাঠের তৈরি পণ্য, চুল, টুপি ইত্যাদি। এসব পণ্যের বেশ কটির রপ্তানিই আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধিও ভালো। দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগেরই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের তথ্য আছে ইপিবির তালিকায়।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, মূলত বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমেই অপ্রধান এসব পণ্যের উদ্যোক্তা তৈরি হয়। মূলধন ঘাটতিই তাদের ব্যবসায় সমপ্রসারণের প্রধান অন্তরায়। তাই এসব পণ্য আরো বেশি রপ্তানির সুযোগ থাকলেও তা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের বিনা জামানতে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে আস্থায় নিতে পারে না। পাশাপাশি গত কয়েক বছরের আর্থিক খাতে অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দানে অতি সতর্কতার ফলে এসব উদ্যোক্তা বিপাকে পড়ছেন। তবে এসব পণ্যে সরকারি সহায়তা পেলে মূল কয়েকটি পণ্যের ওপর থেকে সরকারের নির্ভরশীলতা কমবে, পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যেও বৈচিত্র্য আসবে। যা বাজারকে সম্প্রসারণে সহায়তা করবে বলেই মনে করেন তারা।
ইপিবির সর্বশেষ তথ্য মতে, আসবাব রপ্তানিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাংশ এবং আগের বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আসবাবে আয় এসেছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। মসলা রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ শতাংশ বা ৯০ লাখ ডলার এবং আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ২০১৪-১৫ বছরের একই সময় আয় ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
শুকনো খাবার রপ্তানি হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ কম আয় হলেও আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। ওই বছরের আয় ছিল ৯ কোটি ৪২ লাখ ডলার। পেট্রোলিয়াম উপজাতে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। রপ্তানি বেশি হয়েছে ২২ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ২৯৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮৩ শতাংশ বেশি।
এদিকে ওষুধ রপ্তানিতে ৮ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় ছিল ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। রাবারে ২ কোটি ১৫ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ বেশি। গত বছর আয় ছিল ২ কোটি ১ লাখ ডলার।
কাঠ ও কাঠজাত পণ্যে ৩৬ লাখ ১০ হাজার ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৯ লাখ ২০ হাজার ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৪ শতাংশ এবং আগের বছরের চেয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি।
হস্তশিল্পে ১ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ১ কোটি ১০ হাজার ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২ শতাশং কম তবে আগের বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। কাগজ ও কাগজের তৈরি পণ্যে আয় হয়েছে ৪ কোটি ২১ লাখ ডলারের। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ শতাশং এবং আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি আয় এসেছে।
গত অর্থবছরে টেরি টাওয়েল রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ শতাশং এবং আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি আয় এসেছে। পাদুকা (চামড়া তৈরি ব্যতীত) রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাশং এবং আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমকি ৬৯ শতাংশ বেশি আয় এসেছে।
টুপি রপ্তানিতে ৭ কোটি ২৫ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০৫ শতাশং এবং আগের বছরের চেয়ে ১৩০ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় ছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। মানুষের চুল ও পরচুলায় রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫০ শতাশং এবং আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে।
কিছু অপ্রচলিত পণ্যের আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিও উঠে আসে ইপিবির তথ্যে। যেমন- গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ফুল রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ ডলারের। কিন্তু রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪৭ লাখ ডলার। ফল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ ডলারের। প্লাস্টিক পণ্যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। কিন্তু রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। কসমেটিকসে ১৮ লাখ ৪০ হাজার ডলারের বিপরীতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গলফ শ্যাফটে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ডলারের।
এ দিকে ইপিবি সূত্র জানায়, ‘এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি’র আওতায় প্রত্যেকটি জেলা থেকে অন্তত একটি রপ্তানি যোগ্য পণ্য খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমকিভাবে সম্ভাবনাময় ১৪ পণ্য নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত ১৪ পণ্য হচ্ছে মৌলভীবাজারের আগর কাঠ ও আগর আতর, খুলনার কাঁকড়া, নাটোরের ভেষজ উদ্ভিদ, দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার সরু ও সুগন্ধি চাল, পঞ্চগড়ের অর্গানিক চা, বান্দরবানের রাবার, সুনামগঞ্জ, ফেনী, ফরিদপুর, জামালপুর, রংপুর ও কুড়িগ্রামের হস্তশিল্প, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও রাঙ্গামাটির হস্তচালিত তাঁতশিল্প পণ্য, দিনাজপুরের পাঁপড়, জয়পুরহাট, চাঁদপুর, বগুড়া, নীলফামারী, মুন্সীগঞ্জ, মেহেরপুর, যশোর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ঝিনাইদহ ও নারায়ণগঞ্জের তাজা শাকসবজি, নেত্রকোনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও নড়াইলের মাছ, চট্টগ্রামে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, খাগড়াছড়ির আনারস ও চুয়াডাঙ্গায় পান।