দেশেই রোটাভাইরাসের ওষুধ ও ভ্যাকসিন উদ্ভাবন

রোটাভাইরাসের ভ্যাকসিন ও ওষুধ উদ্ভাবন করে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করলেন বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী। দেশেই তাঁরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন পাঁচটি ভ্যাকসিন ও ওষুধের মডেল, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। তবে এই গৌরবময় উদ্ভাবনের পেছনে ওই বিজ্ঞানীরা অনুপ্রেরণার কৃতিত্ব দিচ্ছেন কালের কণ্ঠকে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখার পরই অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা নেমে পড়েছিলেন এই উদ্ভাবনী গবেষণায়।

ওই গবেষণাবিষয়ক একটি নিবন্ধ গত ২৩ জুন বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফার্মাকোলজি’তে প্রকাশিত হয়েছে, যা নিয়ে আলোড়ন চলছে দেশে-বিদেশে। আর এই বিরল উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির (এনআইবি) বিজ্ঞানীরা। রোটা নিয়ন্ত্রণে বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগের লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা ওই ভ্যাকসিন ও ওষুধের মডেল তৈরি করেছেন। সম্ভাবনাময় এই এসইউ ভ্যাকসিন (SU1-SU5) তৈরি করা হয়েছে ১৪টি দেশের ২৪টি রোটাভাইরাস জাতের অপরিবর্তনশীল জিন নকশার ওপর ভিত্তি করে।

গবেষকদলের প্রধান এনআইবির মহাপরিচালক ড. মো. সলিমুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, “গত বছরের ২৮ মার্চ কালের কণ্ঠে ‘নিয়ন্ত্রণহীন রোটাভাইরাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পড়ি। এরপর আমি ও আমার দলের ভেতর হঠাৎ করেই যেন অদ্ভুত এক প্রেরণা অনুভব করি। কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন সামনে

নিয়েই আমরা এ ভাইরাসের প্রিথেরাপি হিসেবে ভ্যাকসিন এবং পোস্টথেরাপি হিসেবে ওষুধের মডেল তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। আমরা ভাইরাসের VP4 প্রোটিনের অপরিবর্তনশীল অংশের পেপটাইডকে টার্গেট করে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী কোষের (TIB-cell) সংযোগের ওপর ভিত্তি করে পাঁচটি পেপটাইড ভ্যাকসিনের মডেল তৈরি করি। আমাদের নকশা করা এই ভ্যাকসিন ট্র্যাডিশনাল ভ্যাকসিনের চেয়ে অনাক্রম্য হতে বেশি সাহায্য করবে বলে আমরা আশাবাদী। কারণ এটি তৈরির ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীল অংশ এবং নির্দিষ্ট টার্গেটকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা ট্র্যাডিশনাল ভ্যাকসিনে অনুপস্থিত।” ওই বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমরা পোস্টথেরাপি হিসেবে ওষুধের নকশাও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি, যা রোটা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৪ লাখ শিশু রোটাভাইরাসের কবলে পড়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।’

ড. সলিমুল্লাহ বলেন, ‘এর আগে দেশে আইসিডিডিআরবি রোটাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে কিছুটা ট্রায়াল শুরু করে, যার সঙ্গে আমাদের গবেষণার ভিন্নতা আছে। আমরা থিওরেটিক্যাল মেথডে কাজ করছি, আর অন্যরা করছে সরাসরি প্র্যাকটিক্যাল মেথডে। আমরা মনে করি, থিওরেটিক্যাল মডেল অনেক দ্রুত ও সার্থকভাবে কার্যকর হয়। সময় কম লাগে। এ ছাড়া আমাদের গবেষণা হয়েছে রোটাভাইরাস জাতের অপরিবর্তনশীল জিন নকশার ওপর ভিত্তি করে একাধারে পাঁচটি ভ্যাকসিন ও ওষুধের মডেল তৈরির ওপর। অন্য যাঁরা ট্রায়াল করছেন তাঁরা বিদেশ থেকে মডেল ধার করে এনে তার ভিত্তিতে এখানে ট্রায়ালের চেষ্টা করছেন। আমরা যে কাজটি করেছি, সেটা চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে আমাদের উদ্ভাবিত মডেল নেবে অন্যরা।’

এনআইবি সূত্রে জানা যায়, সাধারণত ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় জিন নকশাসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা ছাড়াই এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এনআইবির মহাপরিচালকের তত্ত্বাবধানে গবেষকদলের সদস্য এনআইবির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু হাশেম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. চমন আরা কেয়া, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ উজ্জল হোসেন রোটাভাইরাস জেনোমের অপরিবর্তনশীল অংশের ওপর ভিত্তি করে পাঁচটি ভ্যাকসিনের মডেল তৈরি করেছেন।

গবেষকরা জানান, রোটাভাইরাস রিওভারাইড গ্রুপের অন্তর্গত চাকার মতো একটি ভাইরাস। এটি খাওয়ার পানি, মল, ঝড় ও বৃষ্টির দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাস সংক্রমণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। রোটাভাইরাস সায়ালিক এসিডের ওপর ভিত্তি করে এপিথেলিয়াল কোষের কার্যাবলি বদলে দেয়। ভাইরাসটি এপিথেলিয়ালের বিশাষক কোষের ক্ষতি এবং অন্ত্রের নিঃশেষণ ও শোষণের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষ সহায়ক পদার্থ বিশোষণ ও ক্ষতিকর পদার্থের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে না। ফলে সংক্রমিত ব্যক্তি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোটাভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠিকমতো না হলেও এদের উপস্থিতিতে যে বিষক্রিয়া হয় তা-ও ডায়রিয়ার কারণ।

জানা যায়, এনআইবি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি জাতীয় জীবপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানে উদ্ভিদ, প্রাণী, মৎস্য, অণুজীব, আণবিক ও পরিবেশ জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবপ্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য এবং জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষক, গবেষক ও পেশাজীবীদের জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবপ্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য থিসিস করার সুযোগ প্রদান এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

অনুপ্রেরণায় কালের কণ্ঠ : কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে এনআইবির মহাপরিচালক ড. মো. সলিমুল্লাহ বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৬৭-৮২ শতাংশই রোটাভাইরাসে আক্রান্ত। অন্যদিকে ছিল রোটাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে নানা জটিলতার কথা। আর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল রোটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়টি। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত আরো বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্তও আমাদের এ গবেষণার কাজে হাত দিতে উৎসাহিত করেছে।’

ড. সলিমুল্লাহ বলেন, ‘কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে দেখলাম, আমাদের দেশে সরকারিভাবে এখনো বিনা মূল্যে রোটাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়নি। এ জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এমনকি রোটাভাইরাসের জটিল কিছু সমাধান করতেও আমাদের বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আবার বেসরকারি পর্যায়ে যে ভ্যাকসিন বাজারে আছে তা-ও অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু আমরা গবেষণা করে দেখলাম, আমাদের মডেল অনুসারে প্র্যাকটিক্যাল ট্রায়াল করতে পারলে আমাদের দেশই এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। আর সেই অর্জন হবে দেশের জন্য যেমন গৌরবময়, তেমনি আর্থিকভাবেও দেশ অনেক সুফল পাবে।’