তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে বাড়ছে উদ্যান ফসলের চাষ। জুম চাষে ফলন কমে যাওয়ায় স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশের বেশকিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে আমসহ বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষের বাগান বাড়াচ্ছে। গত আট বছরে তিন পার্বত্য জেলায় উদ্যান ফসলের চাষ বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এর বিপরীতে ফলন বেড়েছে ৫১ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৭-০৮ মৌসুমে পার্বত্য তিন জেলায় ৬৩ হাজার ৭৬৭ হেক্টর উদ্যান জমিতে ফল উত্পাদন হয়েছিল ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৩ টন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৬৮৪ হেক্টর জমিতে ফল উত্পাদন হয় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৫৩০ টন। এ হিসাবে গত আট বছরে পার্বত্য তিন জেলায় উদ্যান ফসলের চাষ বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এর বিপরীতে উত্পাদন বেড়েছে ৫১ শতাংশ। চলতি মৌসুমে উদ্যান ফসল উত্পাদন আরো এক লাখ টন বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
এক যুগ আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমসহ বেশ কয়েকটি অর্থকরী ফলের চাষ শুরু করে চট্টগ্রামভিত্তিক মেরিডিয়ান গ্রুপ। এর পর থেকে চট্টগ্রামভিত্তিক বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ উদ্যান ফসলে বিনিয়োগ করতে থাকে। কিষোয়াণ গ্রুপ, বনফুল, ইস্পাহানি ও গোল্ডেন এগ্রো পার্বত্য জেলাগুলোয় জমি ইজারা নিয়ে বর্তমানে উদ্যান ফসলের চাষ করছে।
জানতে চাইলে মেরিডিয়ান গ্রুপের এগ্রো বিভাগের প্রধান মো. আবুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, মেরিডিয়ান এগ্রোই প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বান্দরবানের লামা উপজেলায় প্রায় ১০ ধরনের আমের চাষ শুরু করে। ২০-৩০ হেক্টর দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে ১২০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের আম চাষ করা হচ্ছে। পরিবেশগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রকল্পে বিদেশীসহ ভালো মানের ফলের চাষ বাড়ানো হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ পার্বত্যাঞ্চলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন জেলায় উত্পাদন হয় আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, জাম, আনারস, কমলা, আমড়া, আমলকীসহ ৫০ প্রজাতির ফল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্পাদন হয় কলা। সর্বশেষ মৌসুমে তিন জেলায় কলা উত্পাদন হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৬১ টন। এর পরই সবচেয়ে বেশি উত্পাদন হয় কাঁঠাল। ২০১৪-১৫ মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় ফলটি উত্পাদন হয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৪৫ টন। এছাড়া পেঁপে উত্পাদন হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৯০ টন, আম ১ লাখ ৫০ হাজার ২৬৪ ও আনারস ১ লাখ ৪৪ হাজার ২৭০ টন।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ‘পার্বত্য এলাকার মাটি ও আবহাওয়া আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলদ ও অর্থকরী ফসলের জন্য উপযোগী। এক দশক ধরে ব্যক্তিপর্যায় ও বিভিন্ন কোম্পানি পার্বত্য চট্টগ্রামে ফলের বাগান গড়ে তুলছে। মূলত মিয়ানমারের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় বেশ কয়েকটি প্রজাতির আম পার্বত্য এলাকায় ভালো জন্মায়। প্রতি বছর প্রতিটি জেলায় গড়ে ৫০০ হেক্টর করে উদ্যান ফসলের চাষ বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে তামাক চাষ কমে আসবে। পার্বত্যাঞ্চলের ফল রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও সম্ভব হবে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, স্থানীয় কৃষকদের হাত ধরে মিয়ানমার থেকে পার্বত্য এলাকায় রাঙ্গুয়াই জাতের আম চাষ শুরু হয়। এর পর কৃষি বিভাগ আম্রপালি জাতের আম চাষ শুরু করে এলাকাটিতে। চলতি মৌসুমে শুধু বান্দরবান জেলায়ই প্রায় ২০ হাজার আম্রপালি চারা রোপণ করা হয়েছে। সমবায় পদ্ধতির পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও স্থানীয় কৃষক জুমের পরিবর্তে উদ্যান ফসলের চাষ বাড়ছে।
উদ্যান ফসলের চাষ ও উত্পাদন বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (রাঙ্গামাটি) উপপরিচালক রমণী কান্তি চাকমা বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোর আবহাওয়া সমতলের চেয়ে ভিন্ন। দেশে আমদানি হয় এমন অনেক ধরনের ফল ও অর্থকরী ফসল এ এলাকায় চাষাবাদ করা সম্ভব। তবে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উত্পাদিত ফসলের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যায়। এটা বন্ধ করা গেলে উত্পাদিত ফল দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
সশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বিদেশী ফলের চাহিদা বাড়ছে। এতে সমতল ভূমিতে দেশী ফলের বাণিজ্যিক আবাদ কমে যাচ্ছে। একসময় স্থানীয়রা সীমিত পরিসরে বিদেশী ফল উত্পাদন করলেও বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ বাড়ছে। আমের জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি জাত যেমন থাই কাঁচামিঠা, থাই নামডাকমাই, থাই স্বর্ণালী, থাই বেনানা পার্বত্য এলাকায় চাষের উপযোগী বলে প্রমাণ পেয়েছে কৃষি বিভাগ। এছাড়া ভারতীয় জাতের আমের মধ্যে পনিয়া ও মল্লিকা দ্রুত সময়ে ফলন দেয়ায় করপোরেট উদ্যোক্তারা এসব আম চাষে উদ্যোগী হয়েছে।